বেশি দামেও মিলছে না খাওয়ার তেল, সংকট সারাদেশে

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.04.29
ঢাকা
বেশি দামেও মিলছে না খাওয়ার তেল, সংকট সারাদেশে ঢাকার কাওরান বাজারে মুদি দোকান থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনছেন এক ক্রেতা। ১১ মার্চ ২০২২।
[বেনারনিউজ]

পামওয়েল রপ্তানির ওপর ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ও ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে ঢাকাসহ সারাদেশে ভোজ্যতেলের সংকট দেখা দিয়েছে।

ঢাকার বিভিন্ন বাজারে গত দুই সপ্তাহ থেকে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে ব্যবহৃত বোতলজাত সয়াবিন তেল এবং পামওয়েল মিলছে না। কোনো দোকানেই তেলের সরবরাহ নেই। যতটুকু মিলছে তার দাম শতকরা ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি।

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরেও ভোজ্যতেল মিলছে না বলে জানিয়েছেন ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা।

অর্থনীতিবিদ এবং বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা এবং বাজারের ওপর সরকারের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং এই মূল্য বৃদ্ধি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

সরবরাহ নেই

রাজধানীর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকার মুদি দোকান মান্নান জেনারেল স্টোরের সত্ত্বাধিকারী আব্দুল মান্নান শুক্রবার বেনারকে বলেন, গত দুই সপ্তাহ থেকেই সয়াবিন ও পামওয়েলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি জানান, “দুদিন থেকে সরবরাহকারীরা আমাদের আর সয়াবিন তেলের বোতল সরবরাহ করছে না। পুরো এলাকার কোনো দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন দেয়া হচ্ছে না।”

বর্তমানে খোলা তেল বিক্রি করছেন জানিয়ে আবদুল মান্নান বলেন, “আজকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম দুইশ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে এর দাম ছিল ১৬০ টাকা। পামওয়েলের দাম ছিল ১৪০ টাকা। এখন এক লিটার পামওয়েলের দাম ১৯০ টাকা।”

একই এলাকার কালাম ট্রেডার্স এর বিক্রেতা আবুল হোসেন বেনারকে বলেন, “আমাদের দোকানেও কোনো বোতলজাত তেল নেই। বোতলজাত তেলের চেয়ে খোলা তেলের দাম বেশি, ২০০ টাকা লিটার। সেজন্য বোতলের তেল ঢেলে খোলাভাবে বিক্রি করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “সয়াবিন ও পামওয়েলের পাশাপাশি সরিষার তেলের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক লিটার সরিষার তেলের দাম ২০০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা হয়েছে। বোতলজাত সরিষার তেলের দাম প্রতি লিটার ২৮০ টাকা।”

সুপারশপ আগোরার কর্মকর্তারা বেনারকে জানান, ইউক্রেন থেকে আমদানি করা কারনেল ব্রান্ডের সূর্যমুখী তেল প্রতি লিটার ৩২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে এর দাম ছিল ২৮০ টাকা। একইভাবে রাশিয়া থেকে আমদানি করা রাঁধুনি ব্রান্ডের প্রতি লিটার সূর্যমূখী তেল বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকায়।

মিরপুর সাড়ে এগারো এলাকার সঞ্চয়ী এন্টারপ্রাইজের মালিক সুবল সাহা বেনারকে বলেন, “তেলের জন্য আমরা কয়েকটি কোম্পানিকে ফোন করেও কাউকে পাইনি। তারা পুরো এলাকার কোথাও তেল সরবরাহ করছে না।”

দাম আরো বাড়তে পারে

তেলের দাম বাড়ায় সংকটে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। নাখালপাড়া এলাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে একেক দিন একেক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধের কথা বলে পুরো রোজার মধ্যে আটা, ময়দা, ভোজ্যতেলে দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।”

“এখন বেশি দাম দিয়েও তেল পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে দাম আরও বাড়বে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষের আয় তো বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আমরা যাব কোথায়? দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো কার্যকর ভূমিকা দেখছি না।”

বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট ও অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ‘অবগত রয়েছে’ জানিয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক এ.এইচ.এম. সফিকুজ্জামান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমরা মিলারদের কাছে টিম পাঠিয়ে দেখেছি তারা বাজারে সয়াবিন ও পামওয়েলের সরবরাহ ঠিক রেখেছে, সরবরাহ কমায়নি। অর্থাৎ বাজারে মিলাররা সংকট সৃষ্টি করেনি।”

“আমার মনে হয়, মিলারদের পর থেকে খুচরা বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে কোনো স্থানে সমস্যা হয়েছে। আমরা খুঁজে দেখছি,” বলেন তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম মনে করেন বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় অস্থিরতা ও দেশের ঈদকে সামনে রেখে মিলাররা এবং অন্যান্য পক্ষ ভোজ্যতেলের এই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে।

তিনি শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের বাৎসরিক পামওয়েল চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ আসে ইন্দোনেশিয়া এবং ২০ ভাগ আসে মালয়েশিয়া থেকে। সারা বছরে যে পরিমাণ ভেজিটেবল ওয়েল দরকার তার মধ্যে স্বল্প মূল্যের পামওয়েল প্রায় অর্ধেক।”

তাঁর মতে, মিলাররা ইন্দোনেশিয়ার পামওয়েল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে তাদের হাতে থাকা তেল বাজারে ছাড়ছে না। তারা জানে “ঈদের আগে মানুষ তেল কিনবেই। সেকারণে দর বৃদ্ধির জন্য সরবরাহ বন্ধ করেছে।”

ইন্দোনেশিয়া পামওয়েল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত এই মূল্য বৃদ্ধি চলতেই থাকবে বলে মনে করেন তিনি।

প্রভাব বেকারি শিল্পেও

বাংলাদেশের মূল ভোজ্যতেল সয়াবিন ও পামওয়েল। দাম কিছুটা কম হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ পামওয়েল ব্যবহার করেন। পামওয়েল দেশের বাৎসরিক মোট ৩০ লাখ টন ভোজ্য তেলের কমপক্ষে শতকরা ৪০ ভাগ মিটিয়ে থাকে।

রান্না ছাড়াও দেশের বেকারি শিল্পে পামওয়েল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পামওয়েলের দাম বৃদ্ধিতে রোজার মাসেই পাউরুটি, বিস্কুটসহ সকল বেকারি সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারী সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন বেনারকে বলেন, “আমরা পাম ফ্যাট দিয়ে বিস্কুট ও ব্রেড তৈরি করি। সয়াবিন ব্যবহার করি না। পাম ফ্যাটের দাম বৃদ্ধিতে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার অবস্থা। আমরা বাঁচব কীভাবে?”

তাঁদের পণ্যের দাম কম হওয়ায় কোটি কোটি নিম্নবিত্তের মানুষ তাঁদের ব্রেড-বিস্কুট খান বলে জানান তিনি।

“আমাদের প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যের মধ্যে প্রায় ৫০০ কারখানা করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা বন্ধ ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না,” বলেন জালাল উদ্দিন।

এদিকে “আমরা সরকারের বেঁধে দেয়া দামে ভোজ্য তেল বিক্রি করে থাকি,” জানিয়ে ভোজ্যতেল পরিবেশক সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বেনারকে বলেন, “সরকার যা বলবে আমরা সেই দামেই বিক্রি করব।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।