শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে

আহম্মদ ফয়েজ
2024.08.14
ঢাকা
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছাত্র ও গণআন্দোলনের সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ১২ আগস্ট ২০২৪।
[এএফপি]

ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ ‘গণহত্যায়’ জড়িতদের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হতে পারে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

বুধবার শেখ হাসিনাসহ তাঁর ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঢাকায় দুটি হত্যা মামলা ও একটি অপহরণ মামলা দায়ের হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবারের একটিসহ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা দায়ের হলো।

উল্লেখ্য, ৩৫ দিনের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, শিশু, পুলিশ ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ৫২৮ জনের মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে।

এক দিনে তিন মামলা

বুধবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন একজন আইনজীবী।

গত ৫ আগস্ট সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা বুলবুল কবিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী এমএইচ তানিম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে এই অভিযোগটি দায়ের করেন।

তদন্ত সংস্থা অভিযোগটি নথিভুক্ত করেছে জানিয়ে গাজী তানিম বেনারকে বলেন, “তদন্ত শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের নিকট প্রতিবেদন জমা দিবে তদন্ত সংস্থা।”

এদিকে এক ছাত্রকে হত্যা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীকে অপহরণের অভিযোগে বুধবার শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা দায়ের হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাজধানীর কাফরুল এলাকায় ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের ১৮ বছর বয়সী ছাত্র ফয়জুল ইসলাম রাজনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা করেছেন ভিকটিমের ভাই রাজীব।

এছাড়া, ২০১৫ সালে অপহরণ ও ছয় মাস জিম্মি করে রাখার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ চারজনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা আরেকটি মামলা করেন।

মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা দাবি করেছেন, ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে উত্তরা এলাকা থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে আটক করা হয়। পরে তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।

এর আগে মঙ্গলবার মোহাম্মদপুরে মুদি ব্যবসায়ী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে এসএম আমির হামজা নামে এক ব্যক্তি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে হাসিনা তার ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে যেতে বাধ্য হন।

শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। হাসিনা ও আ.লীগের প্রায় সব শীর্ষ নেতা দেশে বা বিদেশে আত্মগোপন করেছেন, কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন।

সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ইউনূসসহ তার সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা জানিয়েছেন এই আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করা হবে।

491c706c-458e-4c43-9624-f8cbb3f00a9d.jpg
সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় বিক্ষোভকারীদের দিকে টিয়ারগ্যাস ছোঁড়ে পুলিশ । ৪ জুলাই ২০২৪। [জীবন আহমেদ/বেনারনিউজ]

বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে

বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।”

গণহত্যা ও গুলিবর্ষণ, এসব ঘটনার জন্য কিছু মামলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রশ্ন করেছে, এটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করার সুযোগ আছে কি না।

সরকার সেটি খতিয়ে দেখেছে দাবি করে আসিফ নজরুল বলেন, এই আইনের অধীনে এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা, যাঁরা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।

ওইসব অপরাধে সাবেক সরকারপ্রধানসহ যাদের “জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে” বা যাঁদের “আদেশ–নির্দেশ থাকার অভিযোগ রয়েছে” তাঁদের কাউকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, “বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদেরও যদি কমান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকে, আমরা সেটা পর্যন্ত খতিয়ে দেখব।”

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করতে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আওয়ামী লীগ সরকার।

এই ট্রাইব্যুনালে বিচারের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক বিরোধী নেতা-কর্মীর সাজা হয়েছে। যাদের অধিকাংশই জামায়াত ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

সাজার মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, যার মধ্যে পাঁচজনই জামায়াতের তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় নেতা।

এই ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং সাবেক কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী।

এ ছাড়া ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর।

দুটি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এসব বিচার হলেও বর্তমানে মামলা কমে যাওয়া একটি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে এবং সেটিরও খুব বেশী তৎপরতা চোখে পড়ে না। 

দুই দিনের চার মামলায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাড়াও অভিযুক্ত গত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক, হাছান মাহমুদ, সালমান এফ রহমান ও জুনায়েদ আহমেদ পলক।

মামলাগুলোতে পুলিশের সাবেক তিন প্রধান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, একেএম শহীদুল হক ও বেনজীর আহমেদকেও মামলাগুলোতে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

1958a205-36db-4b8e-a4f3-09cff2799932.jpg
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করছে পুলিশ। ১৪ আগস্ট ২০২৪। [মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

১০ দিনের রিমান্ডে আনিস-সালমান

রাজধানীর সদরঘাট এলাকা দিয়ে নৌপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার এই দুজনকে বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রিমান্ডে নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন নিউ মার্কেট থানার সাধারণ রেকর্ডিং অফিসার লিয়াকত হোসেন।

আদালতে তাঁদের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।

জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্ত শীঘ্রই শুরু হবে

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনুসকে বুধবার ফোন করে জানিয়েছেন ছাত্র আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারীদের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে খুব শীঘ্রই জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি তদন্ত শুরু করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, টেলিফোনে কথোপকথনের সময় ভলকার তুর্ক জানিয়েছেন, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের একটি দল শিগগিরই তদন্ত শুরু করতে বাংলাদেশে আসবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।