কোটা সংস্কার: আন্দোলনকারীদের বিরল প্রতিবাদের মুখে প্রধানমন্ত্রী
2024.07.15
ঢাকা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সমালোচনা করতে গিয়ে “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?”-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন মন্তব্যের জের ধরে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
সাম্প্রতিক চীন সফর শেষে দেশে ফেরার পর রোববার (১৪ জুলাই) বিকেলে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর রাতেই বিরল সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধানমন্ত্রী।
মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে আসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে স্লোগান দেন।
রাতে কয়েক ঘণ্টা প্রতিবাদ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসে ফিরে যান এবং সোমবার সকালে আবারও নিজ নিজ ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন।
এদিকে রাতে শিক্ষার্থীরা “তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার”; “লাখো শহীদের রক্তে পাওয়া দেশটা কারো বাবার না” এ রকম নানা স্লোগান দেয়। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এসব স্লোগান পোস্ট করা হয়।
শিক্ষার্থীদের এই স্লোগানের সমালোচনা করে সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী কীভাবে দেশে অত্যাচার চালিয়েছে তা তারা জানে না। এসব অত্যাচার, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকা এরা দেখেনি। তাই নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাবোধ হয়নি।”
অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিকে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ’ হিসেবে উল্লেখ করে আলাদা এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রোববার রাতে ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হয়েছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।
প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদকের পর আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাংবাদিকদের বলেন, “এটা স্পষ্ট যে বিক্ষোভকারীরা তাদের সীমা অতিক্রম করছে।”
যারা রাজনৈতিকভাবে সীমা অতিক্রম করেছে তাদের মোকাবেলা করতে জানে ছাত্রলীগ, হুঁশিয়ারি দেন সাদ্দাম।

বিকেলে হামলা, আহত কয়েকশ
দিনভর নানা রকম হুঁশিয়ারি দেয়ার পর বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
শুরুর দিকে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা হলেও শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় ৫০ নারী শিক্ষার্থীসহ কমপক্ষে ২৫০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে দাবি করেছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সারা দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলায় কয়েকশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
দোয়েল চত্বর এলাকায় কমপক্ষে দুটি গুলির শব্দ পাওয়া গেছে এবং বিভিন্ন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছে দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের নেতাকর্মীদের তারা উসকে দিয়েছে। আমরা দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছি। আজ তাদের ৫ মিনিটের মধ্যে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছি।”
অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে ঢুকে বিক্ষোভকারীদের মারধর করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়।
এ সময় ডাক্তার, নার্স এবং রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালটির জরুরি পরিষেবাগুলি কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, সেখানে হামলার কারণে রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয়েছে।
“পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য, আমরা জরুরি বিভাগে আরও নার্স এবং ডাক্তার মোতায়েন করেছি। আহতরা চিকিৎসা নিচ্ছেন,” বলেন তিনি।
এদিকে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের যা বলবে, আমরা সেভাবে কাজ করব। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে এসেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।”
প্রধানমন্ত্রীকে দুঃখ প্রকাশের আহ্বান
রাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার মন্তব্যের জন্য ছাত্র সমাজের কাছে দুঃখ প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন আন্দোলনের আরেক অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
একই সময় তিনি কোটা সংস্কারে একদফা দাবি, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, “আগামীকাল (মঙ্গলবার) সারাদেশের সকল ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।”
এ সময় নাহিদ ছাত্রদের এই আন্দোলনকে গণ আন্দোলনে রূপ দিতে হবে জানিয়ে বলেন, “আন্দোলনকে বৃহত্তর গণ আন্দোলনের পথে যেতে হবে। ছাত্রদের মিছিল ও সমাবেশে সমাজের সকল স্তরের মানুষদের অংশ নিতে অনুরোধ করছি।”
ক্ষমতা হারানোর ভয়ে হামলা: বিএনপি
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ক্ষমতা হারানোর ভয়েই এই হিংস্র হামলা। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিকে রক্তাক্ত পন্থায় দমনের যে দৃশ্য দেশবাসী অবলোকন করল তা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আরেকটি হিংস্র অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে সংযোজিত হবে। এদের হাতে জনগণ, রাষ্ট্র, সমাজ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব কখনোই নিরাপদ নয়।’
প্রসঙ্গত ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে পরিপত্রকে সম্প্রতি অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট।
এরপর চলতি মাসের শুরু থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দেশে ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হতো এবং বাকি ৮০ শতাংশ পদে নিয়োগ হতো কোটায়।
১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে উন্নীত হয় এবং ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেয়া হয়।
এই ৫৫ শতাংশের আওতায় ছিল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ।
পরে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু হলে কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে।