কারফিউ থাকবে, আন্দোলন চালিয়ে যাবে একাংশ
2024.07.21
ঢাকা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চলমান সহিংসতায় গত কয়েকদিনে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর চাকরি কোটা বিষয়ে রোববার রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে কারফিউ জারির দ্বিতীয় দিন, রোববার আদালত প্রাঙ্গণে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর শত শত সদস্যের উপস্থিতি ছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কারফিউর ভেতর কড়া নিরাপত্তায় আদালতে শুনানির ঘটনা ঘটল। সকাল থেকে শুনানির পর আদালত রায় ঘোষণা করে রোববার দুপুরের দিকে।
রায়ে সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধাভিত্তিক নিয়োগের নির্দেশ দেয় আদালত, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থেকে নামিয়ে পাঁচ শতাংশে নিয়ে আসা হয়। একই সাথে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য এক শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীদের জন্য বাকি এক শতাংশ কোটা সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়।
এই রায়কে “কোটা পদ্ধতির চূড়ান্ত সমাধান” বলে উল্লেখ করেছেন সরকারপক্ষের আইনজীবী। রায়কে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একাংশ স্বাগত জানালেও অন্য অংশ মনে করছেন ‘অস্পষ্ট’।
রায়ের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানান, রায় প্রকাশিত হবে মঙ্গলবার। তারপর রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কোটা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে।

শুনশান ঢাকা, দশজন নিহত
কোটা সংস্কার বিষয়ক রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন বেনারনিউজের একজন প্রতিনিধি। তিনি জানান, রোববার সবারই আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল আদালত।
কারফিউ চলমান ও রাস্তায় সেনা মোতায়েন থাকায় পুরো ঢাকা ছিল শুনশান, রাস্তাঘাট ফাঁকা।
আদালত প্রাঙ্গণ ও আশপাশে ছিল বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শত শত সদস্যের উপস্থিতি। সাজোয়া যান নিয়ে উপস্থিত ছিল সেনাবাহিনীও। শুধু অনুমোদিত পাসধারী ব্যক্তিরাই আদালতে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছিলেন।
রোববারেও সারা দেশে অন্তত দশজন নিহত হয়েছেন বলে বেনারনিউজ নিশ্চিত হতে পেরেছে। এর মধ্যে পাঁচজন ঢাকায়, পাঁচজন নরসিংদীতে। এছাড়া আগে থেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা আরো দুইজন মারা গেছেন রোববার। এ নিয়ে কোটা আন্দোলনে কেন্দ্র করে সহিংসতায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৬ জনে।
ঢাকায় নিহত পাঁচজনের প্রত্যেককেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয় বলে বেনারকে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া। নরসিংদীতে নিহতরাও গুলিবিদ্ধ ছিলেন বলে জানা গেছে হাসপাতাল সূত্রে।
রোববার ঢাকার অন্যান্য এলাকা শান্ত ও ফাঁকা থাকলেও আইন যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডা এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
কারফিউ থাকবে, আন্দোলন চলবে
আদালতের রায় ঘোষণার পর কোটা সংস্কার আন্দোলনের ৫৯ জন সমন্বয়ক স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবার কথা বলা হয়। বিবৃতির একটি কপি বেনারনিউজের কাছে রয়েছে।
আদালতের রায়কে ‘অস্পষ্ট’ উল্লেখ করে বিবৃতিতে জরুরি ভিত্তিতে সংসদ অধিবেশন ডেকে এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়।
শতাধিক প্রাণহানির দায় সরকার এড়াতে পারে না উল্লেখ করে এতে, হতাহতের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার এবং নিহতদের পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দেবার দাবিও জানানো হয়।
এদিকে জনমনে ‘শান্তি’ ফিরে না আসা পর্যন্ত কারফিউ চালু থাকবে বলে রোববার সাংবাদিকদের জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
রোববার বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। পরে বিকেল পাঁচটা থেকে আবারো পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। পাশাপাশি বলবত থাকে সেনা মোতায়েন।
রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে চলমান পরিস্থিতিতে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ভোগের জন্য” দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি অভিযোগ করেন, ছাত্রদের আন্দোলনকে ‘সরকার পতনের আন্দোলনে’ পরিণত করেছে বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত।
তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, সারা দেশে সরকার ‘দমন-পীড়ন’ চালাচ্ছে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য তারা বিরোধীদের ওপর দায় চাপাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ভ্রমণ সতর্কতা
আগের কয়েকদিনের বিক্ষোভ, চলমান কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ ও মোবাইল সংযোগ দুর্বল থাকায় বাংলাদেশে জুড়ে সরবরাহ ব্যবস্থা, যোগাযোগ, ব্যাংকিং সহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ায় জনজীবনে চরম ভোগান্তি নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বেনারনিউজের সাংবাদিকেরা।
এদিকে চলমান সহিংস পরিস্থিতি, ইন্টারনেট ও মোবাইল সংযোগ না থাকা এবং সেনা মোতায়েনের কারণে বাংলাদেশ সফর না করার জন্য নিজেদের নাগরিকদের পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি “চূড়ান্ত অস্থিতিশীল ও অনুমানের বাইরে” বলে উল্লেখ করেছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। অন্যদিকে বাংলাদেশে ‘আরো বেশি কড়াকড়ি আরোপ ও পরিস্থিতির অবনতি’ হতে পারে বলে জানিয়েছে জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতি।
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ হতো ৪৪ শতাংশ এবং ৫৬ ভাগ সংরক্ষিত ছিল বিভিন্ন কোটায়, যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের বংশধরদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ৩০ শতাংশ ও নারীদের জন্য দশ শতাংশ।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করে দেয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান সরকারের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট করেন। চলতি বছরের ৫ জুন সেই রিটের রায়ে আদালত সরকারের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়, কোটা ব্যবস্থা আবার পুনর্বহাল হয়।
আদালতের আদেশে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গত ১ জুলাই থেকে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু করে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং গত সপ্তায় আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনার প্রেক্ষিতে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
গত মঙ্গলবার থেকে পুলিশ ও সরকারী দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ কঠোরভাবে আন্দোলনকারীদের বাধা দেয়া শুরু করলে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা বাড়তে থাকে।
রেল স্টেশন, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা এবং গাড়িতে আগুন দেবার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে, বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের অনলাইন গণমাধ্যম। এই অবস্থায় শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার।
রোববার সুপ্রিম কোর্ট গত জুনে হাই কোর্টের দেয়া আগের রায় বাতিল করে নতুন রায় ঘোষণা করে।