হাসপাতাল ভর্তি গুলিবিদ্ধ মানুষে, শিথিল ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ
2024.07.23
ঢাকা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঠেকাতে গিয়ে শুরু হওয়া সহিংসতায় ঢাকার অন্যতম বৃহত্তম হাসপাতাল ভরে আছে গুলিবিদ্ধ মানুষে।
মঙ্গলবার সরেজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ঘুরে সেখানকার চিকিৎসক ও আহত বা নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে আসা প্রায় সবাই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে তাঁরা আহত বা নিহত হয়েছেন।
আহতদের অনেকেই বলেছেন, বিক্ষোভে অংশ না নিলেও এলোপাথাড়ি গুলির মধ্যে পড়ে তাঁরা আহত হন।
গত চার দিনের সহিংসতায় হাসপাতালে এক হাজার ৭১ জন ভর্তি হয়েছেন বলে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, হাসপাতালে আসার আগে ও পরে মারা গেছেন ৭৯ জন। এর মধ্যে মধ্যে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয় ৬০ জনকে, বাকি ১৯ জন মারা যান চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে শুধুই গুলিবিদ্ধ মানুষ। চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জরুরি বিভাগের তিনটি ওয়ার্ডে দুই শতাধিক গুলিবিদ্ধ রোগী ভর্তি রয়েছেন। যাদের মধ্যে আছে বেশ কয়েকজন শিশুও।
হাসপাতালে বিছানা না পেয়ে ফ্লোরে, বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন রোগীরা। গুলিবিদ্ধ বাম পা নিয়ে ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের ফ্লোরে শুয়ে থাকতে দেখা যায় ১০ বছরের শিশু মো. আলিফকে।
আলিফের মা আছমা বেগম বেনারকে বলেন, “ছেলেকে গোসল দেবো বলে পানি ভরছিলাম। এরই ফাঁকে সে একটি ছোট মাছ বয়ামে ভরে খেলতে খেলতে কখন যে রাস্তায় গেছে টের পাইনি। তাকে খুঁজতে খুঁজতেই ফোনে স্থানীয়দের কল পেয়ে জানতে পারি সে গুলিবিদ্ধ।”
আলিফ জানায়, “আমি কিছুই করিনি, খেলছিলাম। হঠাৎ গুলি এসে আমার পা ফুটো করে দেয়। আমি পড়ে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলাম। তখন কয়েকজন লোক আমাকে হাসপাতালে নেয়। সেখানে ডাক্তার আমার পা থেকে গুলি বের করে।”
বেনারনিউজের পক্ষে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা তথ্যমতে গত কয়েকদিনের সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা ১৩৮, তবে দৈনিক প্রথম আলোর হিসেবে এই সংখ্যা ১৮৭। কোটা সংস্কার আন্দোলনে মোট কতজন নিহত হয়েছেন সেই তথ্য মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রকাশ করেনি সরকার।

বেড়েছে কারফিউ শিথিলতা, ফিরেছে ইন্টারনেট
কারফিউর শিথিলতা বাড়িয়েছে সরকার। এখন থেকে ঢাকাসহ কয়েকটা বড়ো শহরে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। জেলাগুলোতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে স্থানীয় প্রশাসন।
পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া ইন্টারনেট মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় রাতের দিক থেকে আবার চালু হয়েছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখনো খুলে দেয়া হয়নি। মোবাইল সংযোগ রয়েছে ধীর গতির।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় গত চার দিন থেকে বন্ধ থাকা বাংলাদেশের গণমাধ্যম মঙ্গলবার রাত থেকে আবারো অনলাইন সংবাদ প্রকাশ শুরু করেছে।
অনলাইন সংযোগ মনিটরকারী সংস্থা নেটব্লকস এক্স-এ এক পোস্টে জানায় পুরা পাঁচদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশে আংশিকভাবে ইন্টারনেট সংযোগ ফিরে এসেছে।
যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মোবাইল সংযোগের ওপর কড়াকড়ি অব্যাহত রয়েছে, যা জনগণের “যোগাযোগ ও তথ্য আদানপ্রদানের’ অধিকারকে খর্ব করে।

আহতদের কথা
দুই চোখে গুলির ছররা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে ভর্তি আছেন আলিম পরীক্ষার্থী তানভীর মোল্লা (২০)।
তাঁর আলিম পরীক্ষা চলছে জানিয়ে মঙ্গলবার তানভীর বেনারকে জানান, “সহিংসতার কারণে পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। এই পরীক্ষায় আর বসতে পারব না।”
“গত শুক্রবার নরসিংদী শহরে বাবার সঙ্গে খালার বাসায় গিয়েছিলাম। বাসা থেকে বের হয়ে অটোরিকশায় ওঠার আগে আকস্মিক গুলি এসে লাগে আমার দুই চোখে, এরপর নানা যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে ঢাকার এই হাসপাতালে আসি।”
ঢামেকের চক্ষু বিভাগে মঙ্গলবার ভর্তি ছিলেন ৪১ জন। চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোশতাক আহমেদ বেনারকে জানান, প্রায় সবার চোখে গুলি লেগেছে।
উত্তরার আজিমপুর এলাকার একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন সোহাগ (২০)। গত শুক্রবার দুপুরে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
কাতরাতে কাতরাতে সোহাগ মৃধা জানান, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া একটি গুলি তার পেটে এসে লাগে, তিনি অজ্ঞান হয়ে যান।
সোহাগের বড়ো ভাই খোকন মৃধা বেনারকে বলেন, গুলিটি পেট দিয়ে ঢুকে পুরুষাঙ্গের পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। এতে সোহাগের একটি অণ্ডকোষ কেটে ফেলতে হয়েছে।
১০১ নম্বর ওয়ার্ডের সামনের বারান্দায় ব্যান্ডেজে মোড়ানো পা নিয়ে শুয়ে ছিলেন অটোরিকশাচালক মো. সোহাগ (১৮)। তিনি বেনারকে জানান, রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে যাত্রী নামিয়ে ইউটার্ন নিতেই একটি গুলি এসে পায়ে লাগলে পড়ে যান তিনি।
এই ওয়ার্ডের বেশিরভাগ রোগীর পেটে গুলি হয়েছে। তবে কারো কারো হাতে, কারো বা পায়ে গুলি লেগেছে।
গৃহপরিচারিকা মা হাজেরা বেগম ধারদেনা করে একমাত্র সন্তানের চিকিৎসা করাচ্ছেন। আর কেউ না থাকায় হাসপাতালের সবকিছু একাই সামলাচ্ছেন তিনি।
এরই ফাঁকে হাজেরা বেনারকে বলেন, “আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। কোনো রাজনীতি করি না, বুঝি না। পেটের দায়ে আমাদের রাস্তায় নামতে হয়, আবার গুলিও খেতে হয়!”
ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে কিছুসংখ্যক আহত ব্যক্তি ভর্তি থাকলেও বেশিরভাগই চিকিৎসাধীন রয়েছেন ঢাকা মেডিকেলে।
আহত সহস্রাধিক পুলিশ
সহিংসতা ঠেকাতে গিয়ে পুলিশের সহস্রাধিক সদস্য আহত হয়েছেন। আহত পুলিশ সদস্যদের বেশিরভাগ চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোমবার রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান। এসময় সাংবাদিকদের তিনি জানান, গত কয়েকদিনের সহিংসতায় এক হাজার ১১৭ জন পুলিশ আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন তিনজন।

চলমান কারফিউয়ের মধ্যে নিখোঁজদের লাশ খুঁজে ফিরছেন স্বজনেরা। ঢামেকের সব লাশ এখনও স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।
সংঘর্ষে নিহত হওয়ার চারদিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে রিকশাচালক গণি মিয়ার (৩৫) মরদেহ খুঁজে পেয়েছে পরিবার।
ঢামেক মর্গের সামনে বসে সুরতহাল প্রতিবেদনের অপেক্ষায় ছিলেন মো. মুজিবর রহমান নামে এক ব্যক্তি। বেনারকে তিনি জানান, রাজধানীর নাখালপাড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বুকে গুলিবিদ্ধ হন তার প্রতিবেশী গণি মিয়া। প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে, পরে ঢামেকে আনা হয়। সেদিন রাতেই তার মৃত্যু হয়। তার পরিবার ঢাকায় এসে অনেক খুঁজেও লাশ পাচ্ছিল না। অবশেষে মঙ্গলবার শনাক্ত করতে পেরেছি।
গণি মিয়ার মেডিকেল সার্টিফিকেটে সংগ্রহ করে দেখা যায়, সেখানে গুলিতে আহত হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে।
গত শুক্রবার রাজধানীর চিটাগাং রোডে কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর থেকে ১৪ বছরের দীপুকে খুঁজে পাচ্ছে না তার পরিবার। দীপুর এক ছবি হাতে থানা-পুলিশ, হাসপাতাল- মর্গ চষে বেড়াচ্ছেন তার মামা তোফাজ্জল হোসেন।
“শুক্রবার থেকেই তাকে খুঁজছি। আজ ছবি দেখে একজন জানালেন, আহত অবস্থায় একজন দীপুকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করে চলে যান। সেই হাসপাতালে জানিয়েছে, সেদিন রাতেই দীপুকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। সব ওয়ার্ড খুঁজে তাকে পেলাম না, তাই মর্গে এসেছি,” বলছিলেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার থেকে শনি-এই চার দিনের টানা সহিংসতায় ঢামেকের মর্গে যেসব মরদেহ আনা হয় তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। নিহতদের মেডিকেল রিপোর্ট থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সরকার আলামত ধ্বংস করছে: বিএনপি
ছাত্র আন্দোলন সামলাতে ব্যর্থতা ঢাকতে কারফিউ জারি করে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের সরকার গ্রেপ্তার করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, কারফিউ জারি করে সরকার বর্তমানে নিরীহ জনগণের ওপর হামলা ও হত্যাকাণ্ডর ‘আলামত ধ্বংস’ করছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত কয়দিনে এক হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে চাকরি কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে চার দফা দাবি নিয়ে সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন।
তাঁদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, ইন্টারনেট পুনরায় চালু করা, কারফিউ প্রত্যাহার, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ক্যাম্পাস থেকে নিরাপত্তারক্ষী সরিয়ে হলগুলো খুলে দেয়া।
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে ২০১৮ সালের আগে পর্যন্ত মেধাভিত্তিক নিয়োগ হতো ৪৪ শতাংশ এবং ৫৬ ভাগ সংরক্ষিত ছিল বিভিন্ন কোটায়, যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের বংশধরদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ৩০ শতাংশ ও নারীদের জন্য দশ শতাংশ।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করে দেয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান সরকারের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট করেন। চলতি বছরের ৫ জুন সেই রিটের রায়ে আদালত সরকারের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়, কোটা ব্যবস্থা আবার পুনর্বহাল হয়।
আদালতের আদেশে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গত ১ জুলাই থেকে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনার প্রেক্ষিতে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
গত মঙ্গলবার থেকে পুলিশ ও সরকারী দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ কঠোরভাবে আন্দোলনকারীদের বাধা দেয়া শুরু করলে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা বাড়তে থাকে।
রেল স্টেশন, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা এবং গাড়িতে আগুন দেবার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে, বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের অনলাইন গণমাধ্যম। ১৯ জুলাই দিবাগত রাত থেকে সারা দেশে কারফিউ জারির পাশাপাশি সেনা মোতায়েন করে সরকার।
ওই সময় ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কারফিউ চলাকালে ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ" দেয়া হয়েছে।
সোমবার এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এর আগে সরকার ও আন্দোলনকারী, দুই পক্ষকেই সংযম রাখার আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘ।
প্রসঙ্গত, রোববার সুপ্রিম কোর্ট গত জুনে হাই কোর্টের দেয়া আগের রায় বাতিল করে নতুন রায় ঘোষণা করে।
এতে সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধাভিত্তিক নিয়োগের নির্দেশ দেয় আদালত, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থেকে নামিয়ে পাঁচ শতাংশে নিয়ে আসা হয়। একই সাথে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য এক শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীদের জন্য বাকি এক শতাংশ কোটা সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়।