মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকা রাশিয়ান ৬৯ জাহাজের বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ
2023.02.03
ঢাকা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে রাশিয়ান এমন সাতটি কোম্পানির ৬৯টি পণ্যবাহী বড়ো জাহাজ বা মাদার ভেসেল (এমভি) বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ। এসব জাহাজ যেন প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য নেওয়া হয়েছে ব্যবস্থা।
গত মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফরের পরপরই এমন উদ্যোগ নেওয়া হলো।
গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাভুক্ত একটি জাহাজে রাশিয়ার অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু সরঞ্জাম আসার পর বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে।
গত ১৬ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে নৌ বাণিজ্য দপ্তর সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর ও বিভাগে এবং বিভিন্ন বাহিনীর কাছে নিষেধাজ্ঞাভুক্ত ৬৯টি জাহাজের শনাক্তকরণ নম্বর (ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন) সরবরাহ করেছে।
ওই প্রজ্ঞাপনের একটি অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, “ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট-এর নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, রাশিয়ার সাতটি কোম্পানির ৬৯টি মাদার ভেসেলকে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। নিষেধাজ্ঞাভুক্ত জাহাজের তালিকায় রয়েছে তেল পরিবহনকারী অয়েল ট্যাংকার, সাধারণ পণ্যবাহী কার্গো ভেসেলে, গাড়ি পরিবহনকারী রো রো ভেসেল, ড্রেজার, টাগসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের জাহাজ।”
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, “রাশিয়ার এসব জাহাজ শুধু বন্দরে প্রবেশের ক্ষেত্রেই নিষেধাজ্ঞা নয়, এগুলোর নিবন্ধন, জাহাজের বাঙ্কারিং, শ্রেণিকরণ, সনদায়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, পুনঃসরবরাহ, রিফুয়েলিং, বীমা এবং অন্যান্য সামুদ্রিক পরিষেবা ইত্যাদি নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে সরকারি নির্দেশনা রয়েছে।”
প্রজ্ঞাপনে জাহাজগুলোর আইএমও নম্বর সংযুক্ত করে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের জলসীমায় উপরোক্ত জাহাজগুলোর কোনো রূপ অস্তিত্ব দেখা গেলে বা কোনো তথ্য/উপাত্ত পাওয়া গেলে তা অত্র দপ্তরকে (নৌ বাণিজ্য দপ্তর) জরুরি ভিত্তিতে অবহিত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।”
প্রবেশ ঠেকাতে নানা তৎপরতা
মার্কিন নিষেধাজ্ঞাভুক্ত ৬৯টি জাহাজ বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ ঠেকাতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ও রেজিস্ট্রার অব বাংলাদেশ শিপস ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বেনারকে বলেন, “আমরা শতাধিক লোকাল এজেন্ট ও কার্গো মালিককে সতর্ক করেছি। দেশের সবগুলো সমুদ্রবন্দরকে অবহিত করেছি। বন্দর কর্তৃপক্ষকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ওই জাহাজগুলো পর্যবেক্ষণ এবং কোনো তথ্য পাওয়া মাত্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সব সতর্কতার পরেও নিষেধাজ্ঞাভুক্ত কোনো জাহাজ যদি বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে পড়ে সে ক্ষেত্রে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন, কোস্টগার্ড এবং ডিরেক্টর অব নেভাল অপারেশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত মাসের শুরুর দিকেই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় এই উদ্যোগ নিয়েছে নৌ বাণিজ্য দপ্তর, জানান সাব্বির।
উল্লেখ্য, কোনো জাহাজের রঙ, রূপ বা মালিকানা বদলালেও আইএমও নম্বরের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাভুক্ত রাশিয়ান ‘উরসা মেজর’ নামে জাহাজ স্পার্টা-৩ বাংলাদেশের মোংলা বন্দরে নোঙর করার চেষ্টা করলে তাতে বাধা দেয় সরকার।
আইএমও নম্বর ট্র্যাক করে জাহাজটির বাংলাদেশমুখী অবস্থান জেনে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করায় এ সিদ্ধান্ত আসে। এ নিয়ে তিন দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো দুই পরাশক্তির বিপরীতমুখী অবস্থানে বাংলাদেশ প্রকাশ্যেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সতর্ক হতে মস্কোকে বার্তাও দেয় ঢাকা।
গত মাসে বাংলাদেশ সফরে আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনি দু’দিনের বাংলাদেশ সফর শেষ করার একদিন পরে এই প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে নৌ বাণিজ্য দপ্তর।
মূলত গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পরে রাশিয়ান শতাধিক জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ান জাহাজ ফিরিয়ে দেওয়ার পরে বেনারের সঙ্গে আলাপকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেছিলেন, “অনেক দেশই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মানে না। আমরা বিতর্ক এড়াতে চাই। তাই আমরা রাশিয়াকে বলেছি, আমাদের দেশে মালামাল পাঠানোর ক্ষেত্রে বিষয়টি খেয়াল রাখতে।”
“আমরা এই বিষয়ে খুবই সতর্ক, যাতে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত কোনো পরিস্থিতিতে আমাদেরকে না পড়তে হয়। রাশিয়া বাংলাদেশকে জানিয়েছে যে, তারা ভুলবশত নিষেধাজ্ঞাভুক্ত জাহাজে পণ্য পাঠিয়েছে,” বেনারকে বলেন তিনি।
রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে।
ওই সময় নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, “রাশিয়ান জাহাজটি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে—সে বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে অবগত ছিল না।”
গত মাসের শেষ ভাগে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া জাহাজের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশে পাঠানো দুঃখজনক।”
রাশিয়া জেনেশুনে এ ধরনের জাহাজ পাঠানোয় বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক রয়েছে। এটা আশ্চর্যজনক যে, রাশিয়া একটি জাহাজের নাম পরিবর্তন করেছে। আমরা এটা আশা করি না। আমরা আশা করি, স্যাংশন নেই এমন জাহাজ পাঠাবে রাশিয়া।”
‘অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে না’
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সমানতালে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। ৬৯টি জাহাজ নিষিদ্ধ করার ঘটনা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “এর ফলে বাংলাদেশ বরং সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। কারণ তাকে নিষেধাজ্ঞার মতো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে না।”
তার ভাষ্য, বাংলাদেশের এই উদ্যোগের সঙ্গে ডোনাল্ড লু’র সফরের কোনো সংযোগ নাও থাকতে পারে।
বাংলাদেশের এই উদ্যোগ সম্পর্কে মন্তব্য জানতে বেনার ঢাকায় মার্কিন ও রাশিয়ান দূতাবাসে যোগাযোগ করে। তবে দূতাবাসগুলো এ বিষয়ে শুক্রবার রাত এগারোটা পর্যন্ত তাদের মতামত জানায়নি।
বাংলাদেশে নোঙর করতে না দেয়ায় স্পার্টা-৩ জাহাজটি বাংলাদেশের জলসীমা থেকে ভারতে হালদায় চলে যায়।
ভারতে মালামাল খালাস করে সেখান থেকে অন্য জাহাজে বা সড়ক পথে রূপপুরের মালামালগুলো নিয়ে আসার চেষ্টা থাকলেও সেই চেষ্টা কাজে আসেনি।
ভারতেও থাকতে পারেনি মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা জাহাজটি। ভারত থেকে জাহাজটি চীনের পথে যাত্রা শুরু করেছে বলে ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক খবরে জানায় দৈনিক প্রথম আলো। তবে এটি চীনে পৌঁছেছে কিনা, সে বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, গত ২২ জানুয়ারি নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকা রাশিয়ান দুটি জাহাজ— ‘লিবার্টি হারভেস্ট’ও ‘এমভি কামিল্লা’— রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে নোঙর করে বাগেরহাটের মোংলা বন্দরে।
