রাশিয়া থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টন সার কেনার চুক্তি করেছে সরকার
2023.06.02
ঢাকা
আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতল সম্পর্কের মধ্যেই রাশিয়া থেকে এক লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন মিউরেট অব পটাশ সার কেনার চুক্তি করেছে সরকার।
বৃহস্পতিবার মস্কোতে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ এবং রাশিয়ার স্টেট কর্পোরেশন পোডিনটর্গের মহাপরিচালক আন্দ্রেই সের্গেইভিচ।
শুক্রবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই সার বাংলাদেশে আনা হবে। তবে এই সার আমদানির খরচ সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু পর থেকে মস্কোর ওপর বিভিন্ন নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন অবরোধ আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো।
রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করাই ছিল উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্যে, রাশিয়ার তেল কিনতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার সাথে যেসব দেশ ব্যবসা-বাণিজ্য করবে এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা চালিয়ে যাবে সেসব দেশগুলো মার্কিন সরকারের বিরাগভাজন হবে।
তাঁদের মতে, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প এবং তেল-গ্যাস খাতে রাশিয়ার গ্যাসপ্রমকে কাজ দেয়া নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে আপত্তি রয়েছে, যদিও বাংলাদেশকে তারা সরাসরি কিছু বলেনি।
রূপপুর প্রকল্পের যন্ত্রপাতি বহনকারী জাহাজ উরসা মেজরকে বাংলাদেশে যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়া হয় সে বিষয়ে সরকারকে জানায় মার্কিন সরকার এবং সেই জাহাজকে মংলা বন্দরে প্রবেশ করতে দেয়নি বাংলাদেশ।
ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য র্যাব এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর অবরোধ এবং গণতান্ত্রিক নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবনতি হয়।
সংসদের গত অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, আমেরিকা বাংলাদেশে একটি অগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে।
আমেরিকার নাম উল্লেখ না করে তিনি আরও বলেন, অবরোধ প্রদানকারী দেশ থেকে বাংলাদেশ কিছু কিনবে কি না সে ব্যাপারে ভেবে দেখবে।
কিন্তু এর কিছুদিন পর আমেরিকা থেকে চিনি ও তেল কেনার দুটি প্রস্তাব অনুমোদন করে সরকার।
সমস্যা হবে মূল্য পরিশোধ
এদিকে রাশিয়া থেকে কৃষিপণ্য কিনতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবরোধ আরোপ করেনি বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের বাঁচাতে আমাদের রাশিয়া থেকে সার কিনতে হচ্ছে। আমার মনে হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি বোঝা উচিত এবং আমি মনে করি এব্যাপারে তাদের সাথে আমাদের কোনো ভুল বোঝাবুঝি হবে না।”
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী শুক্রবার বেনারকে বলেন, রাশিয়া থেকে কৃষিপণ্য ও খাদ্যশস্য কেনার ব্যাপারটি পশ্চিমারা ‘বাঁকা চোখে’ দেখলেও তারা হয়তো সরাসরি কিছু বলবে না। কারণ, আমেরিকা তো আর আমাদের এমওপি সরবরাহ করে না।
তিনি বলেন, “তবে সমস্যাটি হবে, বাংলাদেশ কীভাবে মূল্য পরিশোধ করবে তার ওপর। ইউক্রেন আক্রমণের জন্য সুইফট সিস্টেম থেকে বের করে দেয়া হয়েছে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে। রুবল এবং টাকা দিয়ে কারেন্সি সোয়াপও করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় বাংলাদেশ যদি চীনের ইউয়ান দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে তবে সেটি আমেরিকা ভালোভাবে নেবে না।”
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবর ভালো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষা, র্যাবের ওপর অবরোধসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে বলা হচ্ছে।”
তৌহিদ হোসেন বলেন, “তবে বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি চাপ রয়েছে। এই চাপ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের ওপর রয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল সেটিকে সরকারের ওপর চাপ হিসাবে দেখছে।”
সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে সার কেনার বিষয়ে বলতে গেলে আমি বলব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ দেয়া উচিত নয়। কারণ, বিশ্বের খুব কম দেশই এমওপি, সিএসপিসহ বিভিন্ন সার রপ্তানি করে থাকে। এবং এই পণ্য বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা জড়িত।”
“তবে বর্তমান অবস্থায় এই বিষয়টি নিয়ে তো সমস্যা হতেও পারে,” মন্তব্য করেন তৌহিদ হোসেন।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন মিউরেট অব পটাশ সার প্রয়োজন হয় যার শতকরা ৪০ ভাগ রাশিয়া থেকে এবং ৩০ ভাগ কানাডা থেকে আমদানি করা হয়।
এছাড়াও, রাশিয়া থেকে ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) এবং ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেটও আমদানি করা হয়।
কত মূল্যে রাশিয়া থেকে এই সার আমদানি করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে বিএডিসি ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “সারের দাম আগে থেকে নির্ধারণ করা হয় না। একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে এই সারের দাম লেখা হয়।”
বাংলাদেশে সার পাঠানো আগে সেই সময়ে ওই সাময়িকীতে যেই মূল্য বলা থাকে সেই অনুসারে দাম নির্ধারণ করা হয়।
তিনি বলেন, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এমওপি সারের দাম অনেক কমে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর প্রতি মেট্রিকটন সাতশ ডলার ছাড়ায়। কিছুদিন আগে সেটি ৪৭৮ ডলারে নেমে আসে, যা এখনও কমতির দিকে।