রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ প্রত্যাহার করা উচিত: শেখ হাসিনা
2022.07.07
ঢাকা

ইউক্রেন আক্রমণের কারণে অবরোধ আরোপ করে রাশিয়াকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়নি; বরং এই অবরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে কথা বলেন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা জানান, ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর শেখ হাসিনাই প্রথম সরকারপ্রধান যিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেন।
তবে তাঁরা জানান, শেখ হাসিনা কোনো আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ যে গভীর সংকটের মুখোমুখি সেই বিবেচনায় এই আহ্বান জানিয়েছেন।
অবরোধের কারণে সারা বিশ্ব ‘ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে’
শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আজকে আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, যখন সারাবিশ্ব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে, ঠিক সেই সময় ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ফলে পণ্য আমদানিতে বিরাট বাধা আসছে। পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। পণ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
অবরোধের কারণে সারা বিশ্ব “ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং মানুষ কষ্ট ভোগ করছে,” মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমেরিকার এটা বিবেচনা করা উচিত তারা যে স্যাংশন দিচ্ছে তাতে তাদের দেশের লোকও কষ্ট পাচ্ছে। সেদিকেও তাদের দৃষ্টি দেয়া উচিত।”
“এই স্যাংশন যাদের বিরুদ্ধে দিচ্ছেন তাদের আপনারা ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাচ্ছেন। কিন্তু কতটুকু তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ, অথবা নিম্ন আয়ের দেশ সবাই কিন্তু কষ্ট পাচ্ছে,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।
“আমরা সবসময় চেষ্টা করছি, আমরা উৎপাদন বাড়াব, আমাদের খাদ্যটা যেন আমরা নিজেরা উৎপাদন করে চলতে পারি সেই ব্যবস্থাও করব,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু সেই উৎপাদন বাড়াতে আমাদের সার প্রয়োজন, আমাদের ডিজেল প্রয়োজন, আমাদের বিভিন্ন উপকরণ প্রয়োজন। সেটা আমরা পাচ্ছি না।”
তিনি বলেন, “এভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়ার কী অর্থ থাকতে পারে, আমি ঠিক জানি না। এ কারণে আমি বলব, এটাও তো মানবাধিকার লঙ্ঘন করার সামিল। মানুষের যে অধিকার আছে সেই অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়।”
“আমরা আশা করি যে, একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে বিশ্বের মানুষকে শাস্তি দেয়া এখান থেকে সরে আসাটাই বোধ হয় বাঞ্ছনীয়,” বলেন শেখ হাসিনা।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
উদ্দেশ্য ‘বিশ্বের সমস্যাগুলো সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেয়া’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম “রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধের বৈশ্বিক নেতিবাচক দিকের ব্যাপারে কথা বললেন,” বলে বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান।
তিনি বলেন, “তিনি আজকে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে কথাগুলো বলেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো, বর্তমান বিশ্বের সমস্যাগুলো সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেয়া।”
“রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেখানে গমসহ শস্য উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী দুই বছরের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দুর্ভিক্ষ হতে পারে,” বলেন ফারুক খান।
বাংলাদেশ একটি জ্বালানি আমদানিকারক দেশ। দেশের শিল্পকারখানা গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। একইসাথে দেশের প্রায় ৬৫ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস ব্যবহার করে। এই গ্যাসের একটি বড়ো অংশ তরল (এলএনজি) আকারে দেশে আমদানি করা হয়।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ফলে এলএনজি’র দাম কয়েকগুণ বেড়েছে বলে জানান ফারুক খান।
তিনি বলেন, এই অবস্থায় সরকার এলএনজি আমদানি বন্ধ করেছে। ফলে দেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে।
অবরোধে রাশিয়ার লাভ বেশি
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “রাশিয়ার ওপর আরোপিত অবরোধের বিরুদ্ধে চীন কথা বলেছে। ভারতের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, তারাও এই অবরোধের পক্ষে নয়, কিন্তু তারা এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই অবরোধের ব্যাপারে বক্তব্য রাখলেন।”
প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো “অযৌক্তিক নয়” আখ্যায়িত করে তৌহিদ হোসেন বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে তেল-গ্যাসের অবরোধ দেয়ার ফলে “রাশিয়ার তেল থেকে আয় বেড়েছে। তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৭০ ডলার থেকে ১৭০ ডলার হয়েছে।”
তিনি বলেন, “রাশিয়ার তেল-গ্যাস বিক্রি কমেছে শতকরা ১৫ ভাগ। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের লাভ অনেক বেড়েছে। রাশিয়ার তেল-গ্যাস তো ইউরোপ কিনছে। তারাও রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।”
অন্য দিকে “অবরোধের কারণে তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ ও অন্যান্য জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,” বলে জানান তৌহিদ হোসেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবরোধ প্রত্যাহারের কথা বলেননি। তিনি প্রকৃতপক্ষে বলতে চেয়েছেন, যে দেশকে শাস্তি দেয়ার জন্য এই অবরোধ সেই দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। বরং, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষ।”
“রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বে অন্যতম তেল, গ্যাস, গম ও তৈলবীজ সরবরাহকারী দেশ। সেকারণে সারা বিশ্বে এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কথা, যুদ্ধ জাহাজ বন্ধ করা হোক কিন্তু পণ্য পরিবহনকারী জাহাজ যেন বন্ধ করা না হয়,” বলেন শমসের মবিন চৌধুরী।