যৌনসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি থেকে ফিরে আসছেন নারীরা

জেসমিন পাপড়ি
2019.10.16
ঢাকা
যৌনসহ নানা নির্যাতনের স্বীকার হয়ে  সৌদি থেকে ফিরে আসছেন নারীরা সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নারী কর্মীদের সাথে কথা বলছেন ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের একজন কর্মী। আগস্ট ২৭, ২০১৯।
বেনার নিউজ

“তোকে টাকা দিয়ে কিনে এনেছি, যা খুশি তাই করব—এটা বলেই মারধর শুরু করত,” বেনারকে বলছিলেন সৌদি আরব ফেরত এক নারী (সামাজিক নিরাপত্তার কারণে তাঁর নাম প্রকাশ করা হলো না), যিনি গৃহকর্মী হিসেবে দেশটিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন।

“মার খেতে খেতে আমি অজ্ঞান হয়ে যেতাম। ওই অবস্থায় যৌন নির্যাতন করত। জ্ঞান ফেরার পরে সেটা আমি বুঝতে পারতাম। প্রায় প্রতি রাতেই চলত এমন নির্যাতন। আমাকে ঠিকমতো খাবার দিত না,” বলছিলেন ওই নারী।

সৌদি ফেরত এই নারী জানান, প্রায় আড়াই মাস এমন নির্যাতন সহ্য করার পরে একদিন তিনি সৌদি পুলিশের কাছে ধরা দেন। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তাকে জেলে যেতে হয়। এক মাস ১১ দিন জেল খাটার পরে গত ২৬ আগস্ট দেশে ফিরে আসেন তিনি।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাস সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন ৮৫০ জন নারী, যারা যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

বাংলাদেশি নারী কর্মীরা সেখানে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করলেও বিষয়টি নিয়ে বরাবরই নীরব ছিল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তবে সম্প্রতি সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো এক প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে সৌদি আরবে কর্মী হিসেবে যাওয়া নারীরা যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে বলেন, যেকোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হলো সমস্যাটি চিহ্নিত করা। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে সমস্যাটা চিহ্নিত হয়েছে। এটি এখন সমাধান হবে আশা করা যায়।”

তাঁর মতে, “দক্ষ নারী কর্মী পাঠাতে হবে। আর সেখানে তারা যাতে বিপদে না পড়ে, সে জন্য শক্তিশালী মনিটরিং সিস্টেমস তৈরি করতে হবে।”

শরিফুল হাসান বলেন, “সৌদি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে নারী কর্মীদের হাতে মোবাইল ফোন থাকা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে সে সমস্যায় পড়লেই যেকোনো সাথে যোগাযোগ করতে পারে।”

নারী নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে সৌদি সরকারের সাথে আলোচনা চলার কথা জানিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বেনারকে বলেন, “সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ সৌদি আরব সফর করেন। সৌদি সরকারের সাথে আলোচনায় নারী কর্মীদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে। দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।”

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা বেনারকে বলেন, সৌদিতে কাজ করতে যাওয়া নারী কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। খারাপ নিয়োগকর্তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”

“পাশাপাশি সৌদি আরবে বাংলাদেশের নারী কর্মীদের জন্য সেফ হোম বাড়ানো হবে। যাতে সে কোনো সমস্যায় পড়লে সেখানে আশ্রয় নিতে পারে,” বলেন তিনি।

“এ​ ছাড়া সঠিকভাবে বিদেশ যাওয়ার জন্য দেশের মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের ৩০-৩২টি জেলায় সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে,” জানান সেলিম রেজা।

উল্লেখ্য, দুই দেশের মধ্যে করা চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে সৌদি আরবে নারী গৃহশ্রমিক পাঠানো শুরু করে বাংলাদেশ। কিছুদিন না যেতেই দেশটি থেকে ফিরতে শুরু করেন নারী কর্মীরা।

৩৪ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার

গত ২৬ আগস্ট সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসেন আরও ১১১ নারী কর্মী। একদিনে এতো নারীর দেশে ফেরার কারণ খুঁজতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। পরে সেটি সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়।

এতে বলা হয়েছে, এসব নারী কর্মীদের ৩৪ শতাংশ অর্থাৎ ৩৮ জন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। ৪৮ জন নারী জানান, তাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়া হতো না। প্রতিবেদনে এসব নারীর ফেরার ১১টি কারণ চিহ্নিত করা হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, পর্যাপ্ত খাবার না দেওয়ায় ২৩ জন, ছুটি না দেওয়ায় চারজন, একাধিক বাড়িতে কাজ করানোর জন্য সাতজন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১০ জন, পারিবারিক কারণে একজন, ভিসার মেয়াদ না থাকায় আটজন, দুই বছরের চুক্তি শেষ হওয়ায় ১৬ জন এবং অন্যান্য কারণে দুজন ফিরে এসেছেন। এসব নারীর মধ্যে ৩৪ জন সৌদি যাওয়ার এক থেকে ছয় মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসেন।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বেনারকে বলেন, “প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তা সত্যি ভয়াবহ, উদ্বেগজনক।” তিনি বলেন, “আমরা সৌদি আরবে কর্মী পাঠাবো। কিন্তু তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে আগে।”

মন্ত্রণালয়ের উত্থাপিত প্রতিবেদনটি সংসদীয় কমিটিতে সেদিন সময়ের অভাবে আলোচনা করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পরে আমরা করণীয় সম্পর্কে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করব।”

নানা ধরনের নির্যাতন

প্রতিবেদনের শুরুতে যে নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছিল তিনি এক বছর চার মাস সৌদি আরবে ছিলেন। এই সময়ে একবার তাঁকে বিক্রিও করে দেয় গৃহকর্তা।

বেনারকে ওই নারী বলেন, প্রথম এক বছর দেড় মাস যে বাসায় ছিলাম তারা বেতন ঠিকমতো দিত না। দেশ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন বলা হলেও সৌদি মালিক তা দিত না। উপরন্তু আমাকে নিয়ে তাদের আত্মীয়দের বাসায় কাজ করাতো। শেষ দিকে আমি যখন প্রতিবাদ করতাম তখন আমাকে অন্য একটি বাসায় পাঠানো হলো।”

“সেখানে আমাকে শারীরিক নির্যাতন করত। তাদের তথ্য অনুযায়ী প্রায় চার লাখ টাকায় ওরা আমাকে কিনেছে। এ জন্য আমাকে দিয়ে যা খুশি করাতে চাইত ওরা,” বলছিলেন তিনি।

ওই নারী বলেন, “ওরা আমার বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে বলে আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিত। আমার কাছে ফোন ছিল না বলে বাড়িতে কথা বলে সত্য–মিথ্যা জানতে পারতাম না। তবে দেশে ফিরে জানতে পারি, তারা মিথ্যা বলেছে।”

“উপরন্তু আমার মা দালালকে ৬০ হাজার টাকা দিয়েছে আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। সৌদি মালিকের নির্যাতনে আমি এখন অনেক অসুস্থ্। এখনো আমার চিকি ৎসা চলছে,” বলেন তিনি।

ওই নারীর মা সাহিদা বেগম বেনারকে বলেন, “আমার মেয়ের আট বছরের একটি মেয়ে আছে। স্বামী তাদের খোঁজ নেয় না বলে মেয়েটির ভবিষ্য ৎ চিন্তা করেই ৪০ হাজার টাকা খরচ করে বিদেশে যায়। অথচ সে কিছুই আয় করতে পারেনি। উল্টো অসুস্থ হয়ে ফিরেছে।”

“তাকে ফিরেয়ে আনতে দালালকে আমি আরও টাকা দিতে বাধ্য হই। এক কথায় এখন আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি,” বলেন তিনি।

সৌদি থেকে ফেরত আসা কেরানীগঞ্জ জেলার এক নারী বেনারকে বলেন, মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হই। মালিক ও তাঁর বড় ছেলে মিলে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করত। খাবার দিত না। বেতন দিত না। বাড়িতে কথাও বলার সুযোগও পেতাম না।

মৃত্যুর বড় কারণ আত্মহত্যা!

প্রতি বছর বিদেশে নারী কর্মীদের মৃত্যু বেড়েই চলেছে। যার বড় একটি অংশের মৃত্যুর কারণ বলা হচ্ছে আত্মহত্যা। ব্র্যাকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে মৃত্যুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক)।

ব্র্যাক অভিবাসন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম নয় মাসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থেকে ১১৮ নারী গৃহকর্মীর মৃতদেহ ফিরেছে। এর মধ্যে ৩৬ জনই আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। আর গত তিন বছরে বিদেশে আত্মহত্যা করা নারীর সংখ্যা ৭২।

জানা যায়, ২০১৬ সালে একজন নারী কর্মী আত্মহত্যা করেছিলেন। ২০১৭ তা বেড়ে হয় ১২ জন। ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করার নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩ জনে।

তবে স্বজনরা বলছেন, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন সইতে না পেরেই হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তাঁরা। আবার অনেকের অভিযোগ, নির্যাতন করে মেরে ফেরার পরে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে বলেন, “একটু সচ্ছলতার জন্য আমাদের মেয়েরা বিদেশে যায়। পরিবার–পরিজন ফেলে সেখানে তাঁর আত্মহত্যা করার কথা না। নিশ্চয়ই সেখানে এমন ভয়ংকর কিছু তাদের সাথে ঘটে, যাতে তারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।”

শরিফুল বলেন, “আমাদের ‍উচিত প্রতিটি মৃত্যুর কারণ খুঁজে দেখা।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।