মধ্যপ্রাচ্যে ৮০ তরুণী পাচারে জড়িত চক্রের তিন সদস্য রিমান্ডে

জেসমিন পাপড়ি
2022.02.15
ঢাকা
মধ্যপ্রাচ্যে ৮০ তরুণী পাচারে জড়িত চক্রের তিন সদস্য রিমান্ডে দুবাইগামী প্রবাসী স্বজনকে বিদায় জানাতে এসে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অশ্রুসজল চোখে এক নারী। প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশ থেকে অনেক নারীও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যান। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অনেক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিক্রিও করে দেয় পাচারকারীরা। ২৫ জুন ২০০৮।
[রয়টার্স]

চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাম থেকে তরুণীদের সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গত আড়াই বছরে এই চক্রের সদস্যরা দুবাই, সৌদি আরব এবং ওমানে ৮০ জন নারীকে পাচার করেছে বলে জানায় সংস্থাটি।

বিমানবন্দর থানা পুলিশের সেকেন্ড অফিসার এসআই সুমন হালদার বেনারকে বলেন, তিন মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে মানবপাচার আইন মামলা হয়েছে। তাঁদের মঙ্গলবার আদালতে তুলে রিমান্ড আবেদন করা হলে প্রত্যেকের এক দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে।

গত রোববার রাতে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়ক এলাকায় অভিযান চালিয়ে দলটিকে আটক করা হয়। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের সম্পর্কে তথ্য জানান র‌্যাব- ১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল-মোমেন।

আটক তিনজন হলেন; আজিজুল হক (৫৬), মোছলেম উদ্দিন ওরফে রফিক (৫০) ও মো. কাউছার (৪৫)। এ সময় তাঁদের সঙ্গে থাকা তিন তরুণীকে উদ্ধার করা হয়, যাদের দুবাই পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। এ ছাড়া আটকদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট, তিনটি মোবাইল ফোন ও নগদ ২৭ হাজার টাকাও জব্দ করা হয়।

এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল সিআইডি।

নারী পাচারের অভিযোগে আটক তিন ব্যক্তিকে ঢাকায় গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে র‍্যাব। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২। [সৌজন্যে: র‍্যাব]
নারী পাচারের অভিযোগে আটক তিন ব্যক্তিকে ঢাকায় গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে র‍্যাব। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২। [সৌজন্যে: র‍্যাব]

দরিদ্র নারীরাই টার্গেট

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ জানান, এই মানব পাচারকারী চক্রটি কিশোরী ও তরুণীদের টার্গেট করে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করে আসছিল। মূলত পাচারের পর তাঁদের বিভিন্ন হোটেলে বিক্রি করে দেওয়া হতো। এই চক্রটি চাকরির কথা বলে গ্রাম থেকে সুন্দরী তরুণীদের এনে একটি চক্রের কাছে বিক্রি করত।

তিনি বলেন, “মানব পাচারকারী চক্রের টার্গেট ছিল দরিদ্র মানুষ। পাচারকারীরা ভালো বেতনে বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল মানুষদের ফাঁদে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে।”

“তাদের পাতা জালে জড়িয়ে অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে এসব মানুষেরা, যাদের অধিকাংশই নারী। পাচারের পর এসব নারীদের বিক্রি করে দিত চক্রটি। তাদের জোরপূর্বক সম্পৃক্ত করা হয় ডিজে পার্টিসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে,” বলেন তিনি।

এই মানব পাচারকারী চক্রের হোতা মো. মহিউদ্দিন (৩৭) ও মোছা. শিল্পী (৩৫) বর্তমানে দুবাইতে অবস্থান করছেন বলে জানান আব্দুল্লাহ আল-মোমেন।

তিনি বলেন, “তাঁরা বাংলাদেশে অবস্থান করা আজিজুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তরুণীর চাহিদা জানাতেন।”

আটক হওয়া আজিজুল হক এই চক্রের অন্যতম সমন্বয়ক জানিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ বলেন, তাঁর মাধ্যমে দুবাইয়ে অবস্থানরত মহিউদ্দিন ভুক্তভোগী নারীদের বিদেশে যাওয়ার খরচের টাকা পাঠাত। সে অনুযায়ী আরেক পলাতক আসামি তাহমিনা বেগম (৪৮), আটক রফিক ও কাউছার মাঠ পর্যায়ের কম বয়সী সুন্দরী মেয়েদের টার্গেট করত। এরপর বিভিন্ন কোম্পানি ও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এই প্রতারক চক্র মেয়েদের বিদেশে যেতে প্রলুব্ধ করত,” বলেন তিনি।

“পরে এসব তরুণীকে দুবাই পাঠানো হতো, যাদের যাওয়ার খরচ দিতেন মহিউদ্দিন। এই তথ্য আজিজুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে জানিয়েছে,” জানান আব্দুল্লাহ আল-মোমেন।

“কোনো তরুণী বিদেশে যেতে রাজী না হলে নানা ধরনের হুমকিও দিত তারা। এছাড়া এই মানব পাচারকারী চক্র বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বহু পুরুষের কাছ থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করছে,” বলেন তিনি।

র‌্যাব জানায়, নূর নবী ওরফে রানা (৩৫) ও মনজুর হোসেন (৩৩) নামের আরও দুইজন তাঁদের গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। তাঁরাও গ্রাম থেকে তরুণীদের আনাসহ দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে সমন্বয় করতেন।

এসব তরুণীদের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মানবপাচারের সঙ্গে জড়িতদের অনেককে নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে।

নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে

পাচারের শিকার নারীদের নিয়ে কর্মরত সংস্থা বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের (বিএনএসকে) নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বেনারকে বলেন, “নারী অভিবাসনের নামে যারা পাচার করে নারীদের যৌন ব্যবসার মধ্যে ফেলবে ২০১৩ সালের মানব পাচার আইন অনুযায়ী তাদের জামিন অযোগ্য জেল এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আমরা এসব ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।”

তিনি বলেন, “পাচারের শিকার হলে শুধু একজন নারীর জীবন ধ্বংস হয় না। পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্য যারা এই নারীর উপর নির্ভরশীল তাঁদের জীবনও শেষ হয়ে যায়।”

সুমাইয়া ইসলাম বলেন, “রাষ্ট্রকে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিকে অনেক বেশি যত্নশীল হতে হবে। এক্ষেত্রে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিদেশে পাঠাতে হলে গৃহকর্মী হিসেবে নয় বিভিন্ন ম্যানেজেরিয়াল জব বা বড়ো কোম্পানিতে কাজ করার মতো দক্ষ করে তুলতে হবে।”

“নারীদের শ্রম আমাদের সম্পদ। এই সম্পদকে অন্যায়ভাবে অর্থের লোভে ধ্বংস করা যাবে না,” মন্তব্য করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।