ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ডে অশান্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
2023.03.10
ঢাকা

বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহিংসতা বা সংঘাতের ঘটনা নতুন না হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কিছুসংখ্যক নেতাকর্মীর বেপরোয়া আচরণ অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থী নির্যাতন, শিক্ষকের সঙ্গে অশোভন আচরণ, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ওপর হামলা, আধিপত্যের লড়াই ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং ছিনতাই-চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের কারণে প্রতিনিয়তই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে ছাত্রলীগ। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসংগঠনটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল শাখার পাঁচ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের এসব শিক্ষার্থী নবীন একজন শিক্ষার্থীকে র্যাগ-এর নামে রাতভর নির্যাতন করে দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছেন।
ছাত্র রাজনীতির এই বেহাল অবস্থা দেখাটাও ‘অস্বস্তির’ বলে বেনারকে জানান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ কায়কোবাদ।
“ছাত্র সংগঠনগুলো যে অন্যায়, অনিয়ম করছে তার সবগুলোর বিচার ও শাস্তি হওয়া জরুরী। অন্যথায় এই অপকর্ম থামবে না,” বলেন তিনি।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, “দখলবাজি আর চাঁদাবাজির কারণে ছাত্ররাজনীতিকে এখন আর মানুষ আগের মতো সম্মানের চোখে না দেখে নেতিবাচকভাবে দেখে।’
“ইদানীং পত্রপত্রিকা খুললেই দেখা যায়— বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজির নেতিবাচক খবর,” মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি ছাত্রলীগকে “দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে” থাকার আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রপতি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির কথা বলেছেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের দরপত্রে চাঁদাবাজির দায়ে ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদ থেকে অপসারণ করেন সংগঠনটির সাংগঠনিক অভিভাবক আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অশান্ত ক্যাম্পাস, বেপরোয়া ছাত্রলীগ
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নবীন নারী শিক্ষার্থী অনুমতি না নিয়ে হলে ওঠায় ছাত্রলীগের পাঁচ নারী নেতাকর্মীর ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। এর প্রেক্ষিতে গত ১ মার্চ হাইকোর্ট কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেয় যাতে ওই পাঁচ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ওই দিন দুপুরেই ফেনী সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আধিপত্য বিস্তারের জেরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান মিশু ও সহসভাপতি শুভসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।
এভাবেই সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খবরের শিরোনাম হয়েছে ছাত্রলীগ। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে যে-সব খবর গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে— চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চার ছাত্রকে 'শিবির সন্দেহে' সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত ব্যাপক মারধর করে হাসপাতালে পাঠানো। বুয়েটের এক দম্পতির কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ছিনতাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে দুই ছাত্রকে রাতভর নির্যাতন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মাখদুম হলের 'কৃষ্ণ রায়' নামক এক আবাসিক ছাত্রকে বেদম পেটানো। রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা সাধারণ এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে একদল ছাত্রলীগ কর্মীর ‘চাঁদা না দেয়ায়' রাজধানীর বঙ্গবাজারের এক ব্যবসায়ীর দোকান ভেঙে দেয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলায় পরিষদের কমপক্ষে ২০ নেতা-কর্মী আহত। অশোভন আচরণের প্রতিবাদ করায় ইডেন মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে স্ট্যাম্প দিয়ে প্রহার, চুল ছিঁড়ে ফেলা এবং বটি নিয়ে ধাওয়া করার অভিযোগ। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের এক শিক্ষার্থীকে মারধর।
ঢাবিতে এক বছরে ২৭ শিক্ষার্থীকে নির্যাতন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) গত বছর ২০টি ঘটনায় ২৭ শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছে স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (স্যাট) নামের একটি সংগঠন।
২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (ডুজা) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থী নির্যাতনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে স্যাট।
স্যাটের পক্ষ থেকে বলা হয়, পত্র-পত্রিকা ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনা অনুযায়ী ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে শুধু চারটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়েছে। একই বছর ২৬ শিক্ষার্থী হল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনের কোনো কর্তৃত্ব নেই। গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের পক্ষে অ্যাডভোকেসি এবং নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্যাটের সদস্যরা অনলাইনে বুলিংয়ের শিকার হওয়ার পাশাপাশি নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি আবাসিক হলগুলোর অতিথিকক্ষে, যা নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকারকেও হরণ করছে। স্যাট মনে করে, কারও ব্যক্তিগত ডিজিটাল ডিভাইস চেক করাও একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন।
এই অভিযোগ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রব্বানী গণমাধ্যমকে বলেন, নির্যাতন বা অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে অনেককেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কিছু ঘটনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, কিছু চলমান আছে।
নির্যাতনের যত অভিযোগ
ছাত্রলীগের নির্যাতন কখনো কখনো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে দেখা গেছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। সেই ঘটনায় ২০২২ সালে ১৭ বুয়েট শিক্ষার্থীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় আদালত।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে পুরান ঢাকায় দর্জি দোকানদার বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার একটি আদালত ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয়জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত দুইজনকে খালাস দেন আপিল বিভাগ।
২০২১ সালের নভেম্বরে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যুর কারণ ছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান ও তার অনুসারীদের করা মানসিক নির্যাতন।
সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচন নিয়ে চাপ প্রয়োগ, ছাত্রলীগের কিছু কর্মীরা তাঁকে নানাভাবে অপমান ও মানসিক নির্যাতন করে। এই ঘটনায় তিনি স্ট্রোক করে মারা যান। পরবর্তীতে কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ চার শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ছাত্রলীগকে দেখভালের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অন্যতম আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বেনারকে বলেন, “যেসব অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে উঠছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অন্যায় করে কেউই পার পাচ্ছে না।”
ছাত্রলীগ একটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠন হওয়ায় এর ইতিবাচক কাজের তুলনায় নেতিবাচক কাজই বেশি আলোচনায় আসে দাবি করে তিনি বলেন, “তবুও কোনো অভিযোগকে হালকাভাবে নেয়া হয় না।”
ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন বেনারকে বলেন, “ছাত্রলীগের নামে অপরাধ করে কেউই ছাড় পাচ্ছে না। অপরাধের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সবগুলো ক্ষেত্রেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নিতেও প্রশাসনকে সহায়তা করা হচ্ছে।”
দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো ছাত্রলীগ ‘আস্থার নাম’ বলে দাবি করেন এই ছাত্র নেতা।
যদিও দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফলে ছাত্র রাজনীতির পতন হতে হতে তা এখন একটি কুৎসিত রূপ ধারণ করেছে বলে মনে করেন দেশের প্রখ্যাত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
“যে ছাত্ররাজনীতি আমরা এখন দেখছি তা স্বাধীন বাংলাদেশে দেখতে হবে, এমনটি আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে কখনো ছাত্রদল কখনো ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলোকে ভীতিকর করে তুলেছে,” বেনারকে বলেন ফজলুল হক।
গত প্রায় ১৪ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় ছাত্রলীগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “অথচ বাংলাদেশ পাকিস্তানের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি আমাদের স্বপ্ন ছিল ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের লেজুড়মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক ধারা তৈরি করবে।”