ভারত ও ভুটানে বন্য বাঘের সংখ্যা বেড়েছে
2023.07.31
ব্যাংকক

ভারত ও ভুটানে বন্য বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বলে উভয় দেশ দাবি করেছে।
শনিবার বিশ্ব বাঘ দিবসে দু’দেশের সরকার নতুন সংখ্যা প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের বনভূমিতে বর্তমানে তিন হাজার ৬৮২টি বাঘ আছে। এই তথ্য অনুসারে বিশ্বব্যাপী মোট বাঘের ৭৫ শতাংশ এখন ভারতে।
আর ভুটানের বাঘের সংখ্যা ২০১৫ সালে প্রথম পদ্ধতিগত সমীক্ষার পর থেকে ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১৩১টিতে দাঁড়িয়েছে।
বিড়াল প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে বাঘ বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো। বর্ষামণ্ডলীয় ঘন বন থেকে শুরু করে পাহাড় পর্যন্ত এশিয়ায় বিভিন্ন পরিবেশে এদের দেখা মেলে।
ব্যাপক হারে বন উজাড়, আবাসস্থলের ক্ষতি এবং বাঘের হাড় ও চামড়ার উচ্চ চাহিদার কারণে শিকারের ফলে বাঘের সংখ্যা মারাত্মক আকারে হ্রাস পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পৃথিবীতে প্রায় এক লাখ বাঘ ছিল। এখন তা কমে আনুমানিক সাড়ে চার হাজারে ঠেকেছে।
বিশ্বব্যাপী বন্য বিড়াল সংরক্ষণ সংস্থা প্যানথেরার মতে, চীন ও ভিয়েতনামে ঐতিহ্যগত ওষুধ তৈরিতে বাঘের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার হওয়ায় এই দুই দেশে চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
ভুটানের রাজকীয় সরকারের একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, দক্ষিণ এশীয় এই দেশটিতে বর্তমানে প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে শূন্য দশমিক ২৩টি বাঘ বাস করে।
শনিবার জাতীয় বাঘ জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তান্ডি দরজি বলেছেন, “আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে, আমরা বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারছি। দেশের ৮৫ শতাংশের বেশি অঞ্চলে বাঘ রয়েছে।”
ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচার (ডব্লিউডব্লিউএফ) জানিয়েছে, অধিকতর আইন প্রয়োগ, সামাজিক বাঘ সংরক্ষণ কর্মসূচি এবং বাসস্থানের উন্নতির ফলে বাঘ সংরক্ষণে এই সাফল্য এসেছে।
সরকারি সমীক্ষায় বাঘ শিকার, বাসস্থানের ক্ষতি এবং মানব-বন্যপ্রাণী সংঘর্ষকে ভুটানে এই প্রাণীর জন্য উল্লেখযোগ্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
ডব্লিউডব্লিউএফের ভাষ্য, ভুটানে চার হাজার ৪০০ মিটার (১৪ হাজার ৪৩৫ ফুট) উপরে সর্বোচ্চ উচ্চতায় বাঘ দেখার বিশ্ব রেকর্ড রয়েছে।

ভারতে দ্বিগুণ হয়েছে বাঘের সংখ্যা
ভারতে গত পাঁচ দশকে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। দেশটির পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দাবি, বাঘের সংখ্যা ছয় শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এখন তিন হাজার ৬৮২ হয়েছে।
প্রথম সর্বভারতীয় বাঘ শুমারিতে ১৯৭২ সালে মাত্র এক হাজার ৮২৭টি বাঘ পাওয়া গিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে দেশটিতে বাঘ ছিল আনুমানিক ৪০ হাজার।
“বাঘ সংরক্ষণে ভারতের দৃষ্টান্তমূলক প্রচেষ্টা এবং বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়; বরং একটি জাতির সংকল্প ও প্রতিশ্রুতির প্রমাণ,” বলেন কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী ভূপেন্দর যাদব।
ভারতে বাঘের বসবাস মূলত ৫৩টি সংরক্ষিত এলাকায় কেন্দ্রীভূত যা দেশের মোট ভূমির দুই দশমিক তিন শতাংশ অর্থাৎ ৭৫ হাজার ৭৯৬ বর্গ কিলোমিটার (২৯ হাজার ২৬৪ বর্গ মাইল) এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।
“কিছু সংরক্ষিত অঞ্চল উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখাতে পেরেছে, অন্যরা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। অন্তত ৩৫ শতাংশ বাঘ সংরক্ষণ অঞ্চলের জন্য বর্ধিত সুরক্ষা ব্যবস্থা জরুরি। বাসস্থান পুনরুদ্ধার, বাঘ যেসব প্রাণী শিকার করে বাঁচে তার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে সেখানে নতুন করে বাঘ ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন,” বলা হয় বিবৃতিতে।

গত বছরের শুমারি অনুসারে প্রতিবেশী দেশ নেপালে ২০১০ সাল থেকে বাঘের সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়ে ৩৫৫টি হয়েছে।
মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন ও বন উজাড়ের কারণে বিশ্ব প্রাণ বৈচিত্র্যের ক্রমবর্ধমান ক্ষতির সঙ্গে লড়াই করে বাঘের জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি সুখবর। তবে অধিকতর মাত্রায় মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘর্ষের উদ্বেগ রয়ে গেছে। ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভারতে বাঘের আক্রমণে শতাধিক মানুষের প্রাণ ঝরেছে।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল শনিবার এক বার্তায় বলেছেন, “যখন বাঘের সংখ্যা বাড়ছে, তখন মানব-বাঘের সংঘর্ষের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সংরক্ষিত এলাকাসহ আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকা উচিত, সেই সঙ্গে বাঘের জন্য শিকার প্রজাতির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, বলেন দাহাল।
বাঘ একটি বিপন্ন এবং সংরক্ষিত প্রজাতি, কারণ তাদের দেহাংশ বিশ্বব্যাপী ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে অবৈধ বন্যপ্রাণী ব্যবসায় বিক্রি হয়।
পৃথিবীর ১৩টি বাঘ অধ্যুষিত দেশের মধ্যে নেপাল, ভুটান ও ভারত রয়েছে; যারা ২০১০ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে।
পাচারের কেন্দ্রে বাংলাদেশ?
২০১৮ সালে পরিচালিত সর্বশেষ বাঘ শুমারি অনুসারে, বাংলাদেশের প্রধানত সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রায় ১১৪টি বাঘ রয়েছে।
এক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত নতুন গবেষণায় বাংলাদেশকে “বিপন্ন বাঘের অবৈধ শিকার ও পাচারের প্রধান কেন্দ্র” বলা হয়েছে, যা আগে চিহ্নিত হয়নি।
প্যানথেরা ও চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস পরিচালিত ওই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয়েছে, সুন্দরবন অঞ্চলে প্রায় ৩০টি জলদস্যু গোষ্ঠীর কারণে বাঘের জনসংখ্যা ৫০ শতাংশর বেশি কমেছে। ২০০৯ সালে ৩০০-৫০০টি বাঘ ছিল, যা থেকে কমে ২০১৮ সালে আনুমানিক ১১৪টিতে দাঁড়িয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সুন্দরবন, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং উত্তর মিয়ানমার থেকে শিকারকৃত বাঘের দেহাংশ পাচারে বাংলাদেশের দেশি ও বিদেশি অভিজাতদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ আছে।
“এই চাহিদার নেতৃত্বে আছে ভারত, চীন ও মালয়েশিয়া। তারপরে যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি থেকে অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান পর্যন্ত উন্নত জি-২০ ভুক্ত দেশগুলো রয়েছে,” উঠে আসে গবেষণায়।

বিজ্ঞানীরা বাঘ শিকারের চারটি উৎস অঞ্চল শনাক্ত করেছেন। এগুলো হলো—ভারত ও বাংলাদেশজুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন, ভারতের কাজিরাঙ্গা-গরমপানি পার্ক, মিয়ানমারের উত্তর ফরেস্ট কমপ্লেক্স এবং ভারতের নামদাফা-রয়্যাল মানস পার্ক।
অবৈধ বন্যপ্রাণী বাণিজ্যে জড়িত চোরাকারবারিরা অধিকাংশই সংশ্লিষ্ট লজিস্টিক কোম্পানির মালিক। কিছু ক্ষেত্রে এরা বৈধ বন্যপ্রাণী ব্যবসার অনুমোদনপ্রাপ্ত। বৈধ ব্যবসার আড়ালে তাঁরা অবৈধভাবে বাঘের দেহাংশ পাচার করেন।
গবেষণার সহলেখক এবং প্যানথেরা টাইগার প্রোগ্রামের পরিচালক অভিষেক হরিহর বলেছেন, “দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে বাঘ শিকারের জন্য শূন্য ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, বাঘ শিকার এখনো এই প্রজাতির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “চীন ও ভিয়েতনামের ব্যবসায়িক অবস্থানের সমতুল্য না হলেও, বাঘের ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ এমন একটি ভূ-খণ্ড যেখানে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী এবং বিজ্ঞানীদের অবশ্যই মনোযোগী থাকা উচিত। বিশেষ করে অবৈধ বাঘ পাচারের সুবিধাজনক অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত বৃদ্ধির কারণে।”