পাঠ্যবইয়ে ট্রান্সজেন্ডার নারীকে নিয়ে গল্পের সমালোচনা করে চাকরিচ্যুত শিক্ষক
2024.01.22
ঢাকা

সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ট্রান্সজেন্ডার নারীর গল্প অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন।
“আমি রোববার পর্যন্ত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস নিয়েছি। তবে রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্লাসে না যেতে বলেছে। তারা আমাকে কারণ জানায়নি, তবে আমি সন্দেহ করছি ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে আমার মতামতের কারণে এমনটি হয়েছে,” বেনারকে বলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মাহতাব শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন পাঠ্যক্রমের একটি বইয়ের দুটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলছেন, যেখানে একজন ট্রান্সজেন্ডার নারীর গল্প রয়েছে।
ওই গল্পে বর্ণনা করা হয়েছে একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী, যিনি একজন পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কীভাবে নারীর মতো আচরণের কারণে পরিবার এবং সমাজে বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। একটি ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ে যোগদান করার পর এবং তাঁর নাম পরিবর্তন করার পরে তিনি মানসিক শান্তি পেয়েছিলেন।
“এটা আমাদের বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করার চেষ্টা। আমি হিজড়াদের অধিকার রক্ষার পক্ষে। কিন্তু এই গল্প তাদের সাহায্য করবে না,” বলেন মাহতাব।
সোমবার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আসিফ মাহতাব উৎস ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তাঁর সাথে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কোনো চুক্তি নেই। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তার কর্মী এবং তাঁদের চুক্তির গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
“ক্যাম্পাসে সবার মাঝে সহযোগিতামূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
চলছে তুমুল বিতর্ক
মাহতাবের চাকুরিচ্যুতির বিষয়টি অনলাইন ও অফলাইনে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
কট্টর ইসলামপন্থী একদল লোক ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং ব্র্যাকের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য বা পরিষেবাগুলি বয়কট করার আহ্বান জানাচ্ছেন। আরেক দল ট্রান্সজেন্ডারদের বিরুদ্ধে দেয়া বক্তব্যের জন্য মাহতাবের সমালোচনা করছেন।
ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে বক্তব্য দেয়ার কারণে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার আসিফ মাহতাবকে চাকরিচ্যুত করার সংবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ওই সংগঠনের সভাপতি শহিদুল ইসলাম কবির গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কাউন্সিল সভাপতি বলেন, “আসিফ মাহতাব ১৯ জানুয়ারি, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সেমিনারে পাঠ্যপুস্তকে ট্রান্সজেন্ডারের নামে ইসলামে নিষিদ্ধ সমকামিতাকে উৎসাহিত করার গল্পের উদ্ধৃতি দিয়ে সমকামিতা থেকে ৯২% মুসলমানদের সতর্ক করতে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এ বক্তব্যের কারণে লেকচারার আসিফ মাহতাবকে শিক্ষাদান থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে সমকামিতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।”
শহিদুল ইসলাম বলেন, ৯২% মুসলমানদের দেশে ট্রান্সজেন্ডারের নামে সমকামিতা দেশের মানুষ যেমন মেনে নেবে না, তেমনি লেকচারার আসিফ মাহতাবকে পাঠদান থেকে বিরত রাখা সহ্য করবে না।
তিনি বলেন, “আসিফ মাহতাবকে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি পুনরায় পাঠদানের ব্যবস্থা না করে, তবে মুসলমানরা শুধু ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় নয় ব্রাক সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান বয়কট করতে বাধ্য হবে।”
আলাদা বিবৃতিতে জনগণকে আসিফ মাহতাবের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক পরিষদ নামের একটি সংগঠনও।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দীন বলেন, “মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির বিপক্ষে বিকৃত লালসা চরিতার্থ করার রুচিহীন কুপ্রবৃত্তিকে উস্কে দেয়ার প্রতিবাদকারী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক আসিফ মাহতাবের প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈরী ও নিষ্ঠুর আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।”
এতে বলা হয়, সপ্তম শ্রেণীর বইতে ট্রান্সজেন্ডার শরীফ থেকে শরীফা হওয়ার গল্পে মগজ ধোলাই করে আগামী প্রজন্মকে নৈতিক অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
লন্ডন-ভিত্তিক বাংলাদেশের সাবেক সাংবাদিক আমিনুল হাসান এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “সমকামিতা আর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এক নয়! একজন দার্শনিকের কাজ আর শিক্ষকের কাজ বইয়ের পৃষ্ঠা ছেড়া নয়। এগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করা, কথা বলা, সমাধান খুঁজে নেয়া।”
“একটা ফোন দিয়ে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করাটা অনুচিত ও অমানবিক। তবে ওই শিক্ষকের বক্তব্য আমার কাছে অসত্য আর অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে,” বলেন আমিনুল।
প্যারিসভিত্তিক বাংলাদেশি লেখক জান্নাতুন নাঈম প্রীতি এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে ট্রান্সজেন্ডারদের মানুষের মর্যাদা দিতে পারেনি, এই বিষয় নিয়ে স্কুলের বইতে যে চ্যাপ্টার আছে সেটা গিয়ে প্রকাশ্যে ছিঁড়েছে জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সেমিনারে। মজার ব্যাপার হলো সে কিন্তু গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় বিখ্যাত তাদের গে কমিউনিটিকে সাপোর্ট করার কারণে।”
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের বিরুদ্ধে প্রচারণার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাংলাদেশের কট্টরপন্থী কিছু আলেম। তাঁরা হিজড়াদের অধিকার সমর্থন করলেও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন “আল্লাহর সৃষ্টিতে হস্তক্ষেপের শামিল” বলে মনে করেন।
রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষদের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য সম্প্রতি ‘জাতীয় ফতোয়া বোর্ড’ নামে একটি সংগঠন করা হয়েছে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি'আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কার্যালয়ে সংগঠনটির একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন বোর্ডের সদস্য মুফতি মীজানুর রহমান সায়ীদ।
বাংলাদেশে জন্মসূত্রে হিজড়া জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনগত অধিকার ভোগ করে থাকেন। যারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করেন তাঁরা রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষ হিসেবে পরিচিত।
বৈশ্বিকভাবে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বলতে হিজড়া ও রূপান্তরিত লিঙ্গ উভয়কে বোঝালেও বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যারা লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তন করেন তাঁদেরকেই ট্রান্সওমেন বা ট্রান্সম্যান (রূপান্তরিত নারী বা পুরুষ) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় বলে বেনারকে জানান ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া কমিউনিটির অধিকার নিয়ে কাজ করা রূপান্তরিত নারী তানিশা ইয়াসমিন চৈতি।