ইউক্রেন পরিস্থিতিতে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ

আহম্মদ ফয়েজ ও জেসমিন পাপড়ি
2022.02.24
ঢাকা
ইউক্রেন পরিস্থিতিতে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় শহর হসটমেল ও আনতোনভ বিমানবন্দরের পাশের একটি রাস্তায় হাঁটছেন একজন স্থানীয় নাগরিক। পেছনে রাশিয়ার বিমান হামলায় আক্রান্ত এলাকা থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২।
[এএফপি]

ইউক্রেন পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশটিতে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দ্রুত দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি এই পরিস্থিতিতে দেশের ও আঞ্চলিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা।

বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “এমন সহিংসতা সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। তাই আমরা সব পক্ষকে সর্বোচ্চ ধৈর্য প্রদর্শন, শত্রুতা বন্ধ করা এবং কূটনীতি ও সংলাপে ফিরে আসার মাধ্যমে এই সংকট সমাধানের চেষ্টা করার আহবান জানাই।”

এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বৃহস্পতিবার জানান, ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের প্রতিবেশী পোল্যান্ডের মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের অশান্ত দেশটি থেকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওয়ারশ তাঁদের ১৫ দিনের অন-অ্যারাইভাল ভিসা দিতে সম্মত হয়েছে।

“ইউক্রেনে অবস্থানরত ২৫০ জন বাংলাদেশি এখন পর্যন্ত একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হয়েছেন এবং সরকারি হিসাব অনুযায়ী আরও প্রায় ২৫০ জন বাংলাদেশি বর্তমানে সেখানে বসবাস করছেন। তবে এই সংখ্যা বেশিও হতে পারে,” বলেন শাহরিয়ার।

“বাংলাদেশ সরকার চার্টার্ড ফ্লাইটের মাধ্যমে ১৫ দিনের মধ্যে পোল্যান্ড থেকে নাগরিকদের সরিয়ে নেবে। বাংলাদেশের ওয়ারশ মিশনে অতিরিক্ত জনবল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জার্মানি ও ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে আসা হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

এ সময় তিনি জানান, ওয়ারশতে বাংলাদেশ মিশন বাংলাদেশি নাগরিকদের শনাক্ত করতে এবং কনস্যুলার পরিষেবার পাশাপাশি তাঁদের অস্থায়ীভাবে বিনামূল্যে থাকার জন্য ক্যাম্প স্থাপনে পোলিশ কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করবে।

অর্থনীতিতে তিন ধরনের প্রভাব পড়বে

ইউক্রেন পরিস্থিতির ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর অন্তত তিন ধরনের সরাসরি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “ইউক্রেনের অশান্ত পরিস্থিতির ফলে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশকে আমদানি, রপ্তানি ও দ্রব্যমূল্যের প্রেক্ষাপটে অন্তত তিন ধরনের প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে।”

তিনি বলেন, “সরাসরি ইউক্রেনের সাথে যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ সেটিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এই পরিস্থিতি এবং ইউরোপের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যও কিছুটা বৈরি পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে।”

এছাড়াও বৈশ্বিক পণ্যবাজার, বিশেষ করে তেলের বাজারে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তার প্রভাবও বাংলাদেশকে প্রবলভাবে মোকাবেলা করতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ তুলা ও আটা আমদানি করে জানিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বিকল্প উৎস হয়তো বাংলাদেশ খুঁজে বের করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদে হলেও একটি ধাক্কার মধ্যে পড়বে বাংলাদেশ।”

এসব প্রভাব মোকাবেলা করতে গিয়ে যেন নাগরিকদের ওপর চাপ না পড়ে, সেজন্য তেল আমদানিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বৈদেশিক ঋণ নিতে সরকারকে পরামর্শ দেন এই গবেষক।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে সংকটের সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন এবং এর বাইরে এই অঞ্চলের অবনতিশীল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।”

এতে বলা হয়, অবনতিশীল পরিস্থিতির ফলে ঢাকা এই অঞ্চলে এবং এর বাইরেও অর্থনীতিতে ইউক্রেন সঙ্কটের সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনা করছে। অনেক বিশ্লেষক এই পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে গুরুতর ইউরোপীয় সংকট বলে অভিহিত করেছেন।

“ইউক্রেনে সহিংসতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন কারণ এই ধরনের সহিংসতা সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বাজেভাবে প্রভাবিত করবে,” বলা হয় বিবৃতিতে।

তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়ার সহযোগিতায় নির্মিত হচ্ছে। এর ওপর কোনো প্রভাব পড়বে কি না, জানতে চাইলে শাহরিয়ার সাংবাদিকদের বলেন, “এর বাস্তবায়ন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এতে এর কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।”

বাংলাদেশিরা ভালো আছেন

ইউক্রেনে আটকা পড়া বাংলাদেশিদের সম্পর্কে জানতে চাইলে পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রায় ৫০০ জনের মতো বাংলাদেশি ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে আছেন। সবার সঙ্গেই প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছি আমরা। সবাই ভালো আছেন।”

তিনি বলেন, “আমরা ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশিদের পোল্যান্ডে আনার উদ্যোগ নিয়েছি। পোল্যান্ড যেন তাঁদের ঢুকতে দেয় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

ইউক্রেনে আটকা পড়া বাংলাদেশি নাগরিক খালেদ হাসান খান বৃহস্পতিবার দুপুরে ইউক্রেন থেকে বেনাকে বলেন, “ভোর পাঁচটা নাগাদ (স্থানীয় সময়) বিকট শব্দে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলে সবার ঘুম ভাঙে। কয়েকদফা গোলা বা বোমার শব্দ শুনতে পাই।”

“টিভি অন করে দেখতে পাই বরিস পোল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশেপাশে বোমা বর্ষণ হয়েছে। ঘটনাস্থল আমার বাড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে হলেও বোমার শব্দের সাথে সাথে ঘরের দরজা-জানালা কেঁপে কেঁপে উঠছিল,” জানান তিনি।

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে স্ত্রী, দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করা খালেদ জানান, এখন পর্যন্ত কোনো সাধারণ নাগরিকের হতাহতের খবর না পাওয়া গেলেও এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আতঙ্কিত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে রাস্তায় ভিড় করছে।

তবে এখনই ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ড বা অন্য কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত না নিলেও আপাতত নিরাপদ আশ্রয়ে যাবেন বলে জানান প্রায় ৪০ বছর ইউক্রেনে বসবাসরত টাঙ্গাইলের বাসিন্দা খালেদ।

সর্বশেষ অবস্থা জানতে রাতে কয়েকবার চেষ্টা করেও খালেদকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

আঞ্চলিক পরিস্থিতি

ইউক্রেন পরিস্থিতি আঞ্চলিক ও বিশ্বনেতাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। নানাভাবে বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছেন তারা।

ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোকো উইদোদো এক টুইটার বার্তায় লিখেছেন, “যুদ্ধ বন্ধ করুন। যুদ্ধ মানবজাতির জন্য দুর্দশা বয়ে আনে এবং বিশ্বকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়।”

মালয়েশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব টুইট বার্তায় লিখেছেন, “ইউক্রেনের সর্বশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের সরকার শঙ্কিত। এখন আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে ইউক্রেনে থাকা মালয়েশিয়ান এবং তাদের পরিবারগুলো নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করা।”

থাইল্যান্ডের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট সেক্রেটারি কুলিত সোম্বাতসিরি জানিয়েছেন, জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই তাঁদের জন্য মূল চিন্তার বিষয়।

“যদিও আমাদের দুই মাসের জ্বালানি মজুদ আছে তবুও তা ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে নাগরিকদের অনুরোধ করা হচ্ছে।”

ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের ঘটনায় এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছ সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমরা ইউক্রেনের দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতি এবং চলমান সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বেসামরিক জনগণের উপর এর প্রভাব হবে ভয়ঙ্কর। যুদ্ধে কোনো বিজয়ী নেই কিন্তু অসংখ্য জীবন শেষ হয়ে যায়।”

তিনি বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই হতাহতের খবর পাচ্ছি এবং মানুষ নিরাপত্তার জন্য তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে দেখছি। বেসামরিক জীবন এবং বেসামরিক অবকাঠামো অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে সব সময় সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।