রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েনি
2022.02.25
ঢাকা

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা পাবনায় রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় আণবিক শক্তি কর্পোরেশন রোসাটমের সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (এনপিপি) নির্মাণ প্রকল্পে কর্মরত ইউক্রেনের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সতর্ক রয়েছে বাংলাদেশ।
পুলিশের ঈশ্বরদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আসাদুজ্জামান আসাদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এখানে যে দুই শতাধিক ইউক্রেনের নাগরিক আছেন, তাঁরা সবাই মূলত রুশ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তবে সেখানে কোনো ঝামেলা নেই।”
এ ব্যাপারে রুশ নিয়োগদাতারা ইউক্রেনিয়দের আশ্বস্ত করেছেন জানিয়ে ওসি বলেন, “ইতিমধ্যে পুলিশের বিশেষ শাখার একটি দল সেখানে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। তাঁদেরও জানানো হয়েছে, সেখানে কোনো সমস্যা নেই।”
জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খানও দাবি করেন, রূপপুরে রুশ ও ইউক্রেনিয় নাগরিকরা সহকর্মী হিসেবে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছেন।
উল্লেখ্য, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরিতে ভৌত সুরক্ষা ব্যবস্থার (পিপিএস) পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাশিয়ার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান জেএসসি ইলিরনের সাথে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সেখানে কর্মরত রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকদের ওপর দুই দেশের মধ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধের কোনো প্রভাব পড়েছে কিনা জানতে চাইলে রোসাটম বেনারকে বলেছে, “রূপপুর এনপিপি নির্মাণের সাথে জড়িত আমাদের সব কর্মীরাই পেশাদার। তাই তাঁরা সর্বদা একে অপরের সাথে সম্মানজনক এবং শালীন আচরণ করেন।”
বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ পরামর্শক ড. ফরহাদ কামালের মাধ্যমে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে বৃহস্পতিবার তারা এমনটা জানিয়েছে। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন প্রতিষ্ঠিত রোসাটমের প্রত্যাশা, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কোনো প্রতিশ্রুতি ও কাজের সময়সূচি একটুও বিঘ্নিত হবে না।”
এ ব্যাপারে রূপপুর এনপিপি নির্মাণ প্রকল্পের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ওসি আসাদের ধারণা, যুদ্ধ হচ্ছে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর, এতে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই।
সতর্ক থাকা উচিত
পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রূপপুর এনপিপি নির্মাণ প্রকল্পে সাড়ে তিন হাজারের বেশি রুশ এবং দুই শতাধিক ইউক্রেনিয় রয়েছেন। এছাড়া রুশ আক্রমণ সমর্থনকারী বেলারুশেরও পাঁচ শতাধিকসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত আরো কয়েকটি দেশের নাগরিক রয়েছেন সেখানে।
বাংলাদেশি নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বেনারকে বলেন, “যেহেতু এখানে ইউক্রেনের যারা আছেন তারা রাশিয়ার মাধ্যমেই এসেছেন, এক্ষেত্রে চলমান রাষ্ট্রীয় বিরোধ তাঁদের ব্যক্তিগত বা অভ্যন্তরীণ বিরোধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”
“তবুও আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। যেহেতু দেশ দুটি এখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, তাঁদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা-উত্তেজনা থেকে যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতেও পারে। তবে এটা নিম্নপর্যায়ের ঝুঁকি। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো ঝুঁকি তৈরি করেছে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা,” বলেন তিনি।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুটো এলাকাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন সেখানে সৈন্য পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ তাদের কিছু মিত্র দেশ রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
বিবিসি জানিয়েছে, ২০১৪ সালে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এবারের নিষেধাজ্ঞাগুলো তার চেয়েও বড়ো এবং কঠোর হবে বলে উল্লেখ করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি আরো জানায়, এই মুহূর্তটির জন্য কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে রাশিয়া। এর আগে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আরেকটি অংশ ক্রিমিয়া দখল করার জন্য তারা সেখানে সৈন্য পাঠানোর পর তাদের ওপর প্রথম দফায় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।
যে কারণে ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
রূপপুর এনপিপি নির্মাণ প্রকল্পে রাশিয়াই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে উল্লেখ করে মেজর জেনারেল (অব.) রশিদ বলেন, “নতুন নিষেধাজ্ঞার পর দেশটির সাথে এই প্রকল্প চালু রাখার বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে, তা যাচাই করে দেখতে হবে।”
“ইউক্রেন পরিস্থিতি এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশকে খুব সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে,” উল্লেখ করেন এই বিশ্লেষক।
রূপপুর এনপিপি নির্মাণ প্রকল্পের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালের ১৩ মে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং ‘রাশান ফেডারেশনের স্টেট এটমিক এনার্জি কর্পোরেশনের (রোসাটম) মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ২ নভেম্বর রূপপুরে প্রতিটি আনুমানিক এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পন্ন দুই ইউনিট বিশিষ্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি হয়। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ের নির্মাণ কার্যাদি সম্পাদনের জন্য পাঁচশ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দুই দেশের মধ্যে।
এ ছাড়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশকে মোট ১১ দশমিক ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক নম্বর ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করেন।
“এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পথে পা দিয়েছে এবং দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ ক্লাবে পদার্পণ করেছে। আশা করা যায়, আগামী ২০২৩ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে,” বলা হয়েছে রূপপুর এনপিপি নির্মাণ প্রকল্পের ওয়েবসাইটে।
সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য রাশিয়া বাংলাদেশকে সহজ শর্তে একটি বড়ো অঙ্কের ঋণ দিয়েছিল জানিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক রশিদ বলেন, “আমরা তালিকা চূড়ান্ত করলেও তার সব এখনো দেশে আনতে পারিনি। বাকি থেকে যাওয়া ওই অংশটি দেশে আনাও এখন নির্ভর করবে নতুন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আমাদের ওপর কী প্রভাব ফেলবে তার ওপর।”
“এ ছাড়া চলমান যুদ্ধের কারণে ‘সাপ্লাই চেইন’ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জ্বালানী তেলের সংকট এবং উচ্চমূল্য আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে যে হুমকির মুখে ফেলবে তাতে সন্দেহ নেই,” যোগ করেন তিনি।