ইউক্রেনে আটকে পড়া ২৮ বাংলাদেশি নাবিক জাহাজ থেকে নিরাপদ স্থানে
2022.03.03
ঢাকা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে অবস্থানরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’র এক নাবিক নিহত হওয়ার পরদিন বৃহস্পতিবার রাতে আটকে পড়া বাকি ২৮ বাংলাদেশিকে জাহাজ থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
নিহত নাবিকের মরদেহ ইউক্রেনের একটি মরচুয়ারিতে রাখা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার রাতে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন সীমান্তবর্তী দেশ পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন।
তিনি বলেন, “বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটির বাকি ২৮ নাবিক ও অন্যান্য স্টাফদের অলিভিয়া বন্দর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। তাঁরা সবাই ভালো আছেন।”
ইউক্রেনে বাংলাদেশ দূতাবাস না থাকায় সীমান্তবর্তী দেশ পোল্যান্ডে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সেদেশের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত।
নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে নৌ-প্রকৌশলী আরিফের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বলেছেন, কোন পক্ষ আক্রমণ চালিয়েছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই মন্তব্য করবে সরকার।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশি সকল নাবিককে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত এক সপ্তাহজুড়ে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। কোন পক্ষের হামলায় বাংলাদেশের নাবিক নিহত হয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমনকি হামলাটি উদ্দেশ্যমূলক কিনা, তাও স্পষ্ট নয়।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে বাংলাদেশ যুদ্ধবিরোধী নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবে বলে বুধবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভা পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সমর্থনে রুশ হামলা বন্ধে প্রস্তাব পাশ হওয়ার সময়ও ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ।
মৃত্যুর আগে ভাইর সাথে কথা বলছিলেন আরিফ
গত ১৬ জানুয়ারি ভারতের মুম্বাই থেকে তুরস্কের দুটি বন্দরে পণ্য খালাস করে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’। ২২ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক থেকে জাহাজটি পরদিন (২৩ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে যায় বলে বেনারকে জানান শিপিং কর্পোরেশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন মো. মুজিবুর রহমান।
অলিভিয়া ক্লে (এক ধরনের মাটি) নিয়ে অলিভিয়া থেকে ইতালির একটি বন্দরে যাওয়ার কথা ছিল জাহাজটির।
তিনি বলেন, “আমরা জাহাজটিকে চলে আসার নির্দেশ পাঠাই। তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করায় বন্দরের পাইলটিং কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং জাহাজটি আটকা পড়ে।”
বাংলাদেশ সময় বুধবার রাতে নয়টার দিকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়।
ওই হামলায় সাথে সাথে প্রাণ হারান আরিফ। জাহাজে আগুন লেগে যায় এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়।
আরিফের চাচা মাসুদুর রহমান ফোরকান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আরিফ ভিডিওকলে ওর ছোট ভাই প্রিন্সের সাথে কথা বলছিল। তখন ইউক্রেনে বিকাল। ভিডিওকল চলাকালেই হঠাৎ ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটি বিকট শব্দ আসে এবং লাইন কেটে যায়।”
“প্রিন্স মনে করেছিল, টেকনিকাল সমস্যার কারণে কলটি কেটে যায়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “কিছুক্ষণ পরেই জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রিন্সকে ফোন করে জানায় যে, ওই শব্দ ছিল রকেট আক্রমণের এবং আরিফ ওই আক্রমণেই মারা গেছেন।”
তিনি বলেন, হাদিসুর রহমান আরিফ ২০১২ সালে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে চাকরি পান।
নিহত আরিফের গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলায়। বাবার নাম আব্দুর রাজ্জাক।
ফোরকান বলেন, “আরিফের বাবা একটি মাদ্রাসায় স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন। বর্তমানে বাবা-মা দুজনই অসুস্থ। তাঁরা উপার্জন করতে পারেন না। আরিফই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।”
হাদিসুরের চাচা বলেন, “নৌ প্রতিমন্ত্রী আমাকে আজকে ফোন করেছেন। আমরা চাই, ছেলের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনা হোক।”
আরিফ রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ওই জাহাজের তৃতীয় প্রকৌশলী ছিলেন।
আক্রমণের নিন্দা
বাংলাদেশ নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কমোডোর আরিফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “রাশিয়া কোনোভাবেই বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ করতে পারে না। এটি সম্পূর্ণভাবে সকল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। জেনেভা কনভেনশন, আনক্লজ সকল আইনে বলা হয়েছে, কোনো বাণিজ্যিক জাহাজকে আক্রমণ করা যাবে না। কারণ তারা যুদ্ধের কোনো অংশ নয়।”
তিনি বলেন, “সকল বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপদ যাত্রা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো অবস্থাতেই বন্দর হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। সুতরাং, বন্দরে আমাদের জাহাজে আক্রমণ সত্যিই দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। সরকারের উচিত এ বিষয়ে রাশিয়া সরকারের সাথে আলোচনা করে জাহাজের অন্যান্য নাবিকদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা।”
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আওয়ামী লীগ সাংসদ মো. মজাহারুল হক প্রধান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “বহুদিন ধরে মিডিয়ায় আসছিল যে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করবে। এটি জানার পরও কেন শিপিং কর্পোরেশন এই জাহাজ ইউক্রেনে পাঠাল? এক কথায়, এটি একটি কাণ্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।”
তিনি বলেন, “সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আগামী সভায় আমি এই বিষয়ে শিপিং কর্পোরেশনসহ মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহি করব।”
জাহাজ থেকে ভিডিও কল
নিহত আরিফসহ বাংলার সমৃদ্ধিতে একজন নারী নাবিকসহ মোট ২৯ জন নাবিক ছিলেন।
ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আক্রান্ত হবার পর জাহাজ থেকেই ভিডিও বার্তা
পাঠিয়ে তাঁদের উদ্ধার সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানান নাবিকেরা।
একজন নাবিক নিহত হওয়া ছাড়াও আক্রমণের কারণে জাহাজের পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় বলে ভিডিও বার্তায় জানান জাহাজের জাহাজের দ্বিতীয় প্রকৌশলী আসিফুল ইসলাম আসিফ।
“জাহাজে আক্রমণের পর কয়েকবার আমার ছেলের সাথে কথা হয়েছে,” জানিয়ে আটকে পড়া নাবিক মাসুম বিল্লাহর বাবা ওবায়দুল হক বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের বলেন, এর পর যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।