ইউক্রেন যুদ্ধ: রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ইঙ্গিত বাংলাদেশের
2022.03.03
ঢাকা

ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পরপরই উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশ বারবার যুদ্ধবিরোধী অবস্থান ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা জানালেও রুশদের সাথে সম্পর্ক জোরদার রাখার ইঙ্গিত মিলছে দায়িত্বশীলদের নানা বক্তব্যে।
ইউক্রেনে নোঙর করে রাখা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজে মিসাইলের আঘাতে বুধবার এক বাংলাদেশি নাবিক নিহত হওয়ার পরদিনই বৃহস্পতিবার রাশিয়ার সহায়তায় উত্তরাঞ্চলে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলেও এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একইদিন সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক বিষয়ক দুটি মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, রাশিয়া থেকে ১৫০ কোটি ২১ লক্ষাধিক টাকা (১৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি) ব্যয়ে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ‘মিউরিয়েট অব পটাশ (এমওপি)’ সার আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের গৃহীত দুই হাজার চারশো মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (আরএনপিপি) স্থাপনের প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমাদের ইচ্ছে আছে, ভবিষ্যতে দক্ষিণাঞ্চলে আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমরা করব।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পর্যবেক্ষণ চলছে কোন জায়গাটায় করলে ভালো হবে।”
এর আগে বুধবারই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভা পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে শেখ হাসিনার যুদ্ধবিরোধী নিরপেক্ষ অবস্থান খোলাসা করেছেন, যা বৃহস্পতিবার বেনারের কাছে তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য রাশিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতার থাকার কথা উল্লেখ করলেও সরকারের অন্যতম এই মুখপাত্র বলেন, “সার্বিকভাবে আমরা যুদ্ধের বিরোধী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) পরিষ্কার বলেছেন, আমরা শান্তিকামী দেশ, শান্তি চাই।”
যুদ্ধে জড়ানো দুটি দেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, “ইউক্রেন আমাদের বন্ধু, আর রাশিয়া-তো দীর্ঘদিনের গভীর বন্ধু।”
এই সংঘাতে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ না নিয়ে “কৌশলগত জায়গা থেকে বাংলাদেশ কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবে,” মনে করেন ভূরাজনীতি ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের মতো আরো অনেক দেশই চলমান সংঘাতে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবে।”
এদিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে বুধবার সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সমর্থনে রুশ হামলা বন্ধে প্রস্তাব পাশ হওয়ার সময়ও ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ।
বিবেচনায় বিকল্প আর্থিক লেনদেন
রাশিয়ার বিরুদ্ধে না যেয়ে বাংলাদেশ ‘সুইফট’ এড়িয়ে সরাসরি আর্থিক লেনদেন স্থাপনে রুশ প্রস্তাবও বিবেচনায় রেখেছে বলে বুধবার বেনারকে নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম।
“ওদের সাথে ‘কারেন্সি সোয়াপের’ (মুদ্রা বিনিময়ের) ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয়কে লিখেছি। তারা চূড়ান্তভাবে আমাদের এখনো কিছু জানায়নি,” যোগ করেন তিনি।
রুশ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সম্মতি চাইলেও সেটা কবে চাওয়া হয়েছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
রাশিয়া থেকে সার কেনার প্রস্তাব অনুমোদনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে দেশটির বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, “নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে বিকল্প উপায়ও আমরা বিবেচনায় রেখেছি।”
“এখন যদি সুইফটের কারণে আমরা পেমেন্ট করতে না পারি, সেক্ষেত্রে কারেন্সি সোয়াপ করে অন্যরকম ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে,” বলেন কামাল।
রাশিয়ার সাথে বিকল্প পথে লেনদেন বা প্রকল্প চালু রাখলে বাংলাদেশ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে কিনা জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, “সঙ্গত কারণেই নিষেধাজ্ঞাভুক্ত ব্যাংকগুলোর সাথে আমরা বা বিশ্বের কোনো ব্যাংক লেনদেন করতে পারবে না।”
“কিন্তু যেগুলো নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই, সেগুলোর মাধ্যমে লেনদেন হবে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগে এটা খুবই একটা সাধারণ বিষয়। এক্ষেত্রে তাদের (পশ্চিমাদের) কিছু বলার থাকবে না,” যোগ করেন তিনি।
“বিশ্বে একটা যুদ্ধ চললে সেটার প্রভাব বিশ্বের সব অঞ্চলেই পড়ে,” উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত যত দীর্ঘ সময় চলবে, তত বেশি ক্ষতি হবে।”
আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারে এই যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের জন্যও ক্ষতিকর হবে বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যে শঙ্কা
সরকার ও বিশেষজ্ঞ দুই পক্ষেরই উদ্বেগ রয়েছে ৯০ শতাংশ রাশিয়ার অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন আরএনপিপি নির্মাণ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম ‘সুইফট’ উল্লেখ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, রুশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ধারাবাহিকতায় ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররাষ্ট্রগুলো ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘সুইফট’ থেকেও তাদের বিচ্ছিন্ন করতে একাট্টা হওয়ায় এই নতুন শঙ্কা।
এছাড়া ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “রোসাটোমের ওপর যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে, সেটি তখন আমাদের জন্য ঝামেলা তৈরি করবে।”
তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জিয়াউল হাসান বেনারকে বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরএনপিপি বাস্তবায়ন নিয়ে এমন কোনো শঙ্কা তৈরি হয়নি, যে ব্যাপারে আমাদের আগাম ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এখন পর্যন্ত প্রকল্পে কোনো প্রভাব নেই।”
রোসাটম কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়ার কথা বলেনি উল্লেখ করে তিনি জানান, তারা বিকল্প উপায়ে রাশিয়া থেকে টাকা আনার জন্যও বাংলাদেশ সরকারের কোনো সহায়তা চায়নি এখনো।
“এত তাড়াতাড়ি প্রভাব পড়ার কথাও না। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তেও কয়েক মাস লেগে যায়,” উল্লেখ করে ভূরাজনীতি বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “শুধু বাংলাদেশ নয়, রাশিয়ার সাথে যাদেরই আর্থিক লেনদেন বা বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে, সব জায়গাতেই এর প্রভাব পড়বে। যুদ্ধ না থামলে এক-দুই মাসের মধ্যেই তা দৃশ্যমান হবে।”
“আরএনপিপি নির্মাণের কোনো প্রতিশ্রুতি ও কাজের সময়সূচি একটুও বিঘ্নিত হবে না,”বেনারকে বলেছে রোসাটম।
“নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো সমস্যায় পড়লে সেটা রোসাটম আমাদের জানাত,” জানিয়ে জিয়াউল হাসান বলেন, “সেখানে রুশ ঠিকাদারদের সাথে কাজ করা বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের বিল আটকে আছে বা স্থানীয় শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছে না, এমন পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি।”
এই প্রকল্পে দেড় বছর ধরে কর্মরত মো. হাসান মিয়াজী বেনারকে বলেন, “রুশদের লেনদেন খুবই ভালো। তবু যুদ্ধ শুরুর পর তারা সামনে ঠিকমতো বেতন দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে এখানে কর্মরত বাঙালীরা কিছুটা আতঙ্কে আছে।”
তবে “কাজ আগে যে গতিতে চলছিল এখনও একই গতিতে চলছে। কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি,” বলেন তিনি।
ড. দেলোয়ার বলেন, “এ জাতীয় বড়ো প্রকল্পে সংকটময় মুহূর্ত মোকাবেলার একটা প্রস্তুতি থাকে। যে কারণে যুদ্ধ দ্রুতই শেষ হয়ে গেলে এখানে কোনো আঁচই লাগবে না।”
পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর রূপপুরে এক হাজার ৬২ একর জমির ওপরে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (এক লাখ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা) ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জ্বালানি ইউরেনিয়ামও আসবে রাশিয়া থেকে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও যুক্ত থাকবে তারা।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ প্রকল্পের কাজ চলছে রাশিয়ার সহায়তায়। বেলজিয়ামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা সুইফট থেকে রাশিয়া বিচ্ছিন্নতা এসব প্রকল্পের পাশাপাশি দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও প্রভাব ফেলবে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের।