গণতন্ত্র ও মানবাধিকার: বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে
2023.01.09
ঢাকা

বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির তৈরি হওয়া দূরত্ব নানাভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। দুই দেশের কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে নিজ নিজ দেশের অবস্থান তুলে ধরা অব্যাহত রেখেছেন।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের সাম্প্রতিক মন্তব্যের জবাবে রোববার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেন বলেছেন, অন্য দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে শিক্ষা নিতে হবে না।
তাঁর এই বক্তব্যের পরদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি ছাত্র সাঈদ ফয়সাল হত্যার বিচারের দাবিতে এবং বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ‘সচেতন নাগরিক সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভ করেছেন সরকার দলীয় কিছুসংখ্যক নেতাকর্মী।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের কেমব্রিজে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফয়সাল। ফয়সাল হাতে ছোরা নিয়ে ঘুরছেন, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ফোনে এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশ তাঁকে থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হবার পর গুলি চালায় বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
এর আগে গত মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের সাথে ঢাকার শাহীনবাগের একটি বাড়িতে বৈঠক করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রতিবাদের মুখে পড়েন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
সোমবার বেলা দুইটায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সাথে সফররত মার্কিন নিরাপত্তা কাউন্সিলের পরিচালক এইলিন লউবেখারের নির্ধারিত বৈঠকের দুই ঘণ্টা আগে ফয়সাল হত্যার বিচার চেয়ে এই বিক্ষোভ ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেন এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিক্ষোভকারীদের তিনি চেনেন না এবং এ ধরনের বিক্ষোভকে সরকার উৎসাহ দেয় না।
বিক্ষোভের পর রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লউবেখারের বৈঠকটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়।
ওই বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থ ও অগ্রাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচনা হয় বলে সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বৈঠকে দুইপক্ষ “মানবিক সহায়তা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, উন্নয়ন সহযোগিতা, সমুদ্র বিষয়ক নিরাপত্তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ শক্তিশালীকরণ, সাইবার নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন,” বলা হয় ওই বিবৃতিতে।
নেড প্রাইসের মন্তব্য, মন্ত্রীর জবাব
শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র নেড প্রাইস জানান, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে শেখ হাসিনার এমন মন্তব্যকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানায় এবং তাঁর এই কথা এবং কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে কি না তা যাচাই করে দেখবে মার্কিন সরকার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন কীভাবে শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ এবং সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেটি বোঝার চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
নেড প্রাইসের এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন রোববার সিলেট বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭২ ভাগ মানুষ মনে করে সেখানে গণতন্ত্র দুর্বল।
মোমেন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ শতাংশের কম মানুষ ভোট দিতে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে শতকরা ৭২ থেকে ৭৩ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। এখানকার নির্বাচন খুবই অংশগ্রহণমূলক, স্বতঃস্ফূর্ত এবং উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে লুকানোর কিছু নেই যে কোন দেশ সেটি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে গণতন্ত্র শেখানোর প্রয়োজন নেই।
উল্লেখ্য, ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিশ্বের ১৬৫ টি দেশের যে গণতন্ত্র সূচক ২০২১ সালে প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫ তম, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ২৬।
কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা নির্ণয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে একটি পরিসংখ্যানগত কাঠামো ব্যবহার করে থাকে। ২০২১ সালে ৩৯ নম্বর পাওয়ায় বাংলাদেশ ‘অংশত মুক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়, অন্যদিকে ৮৩ নম্বর পেয়ে ওই সূচকে যুক্তরাষ্ট্র মোটের ওপর মুক্ত বা গণতান্ত্রিক হিসেবে চিহ্নিত হয়।
২০২১ সালের ৯ ও ১০ ডিসেম্বর ভার্চুয়ালি গণতন্ত্র সম্মেলন আয়োজন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সম্মেলনে ১১০টির বেশি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও সেই তালিকায় ছিল না বাংলাদেশের নাম।
বিক্ষোভ, মানববন্ধন
রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লউবেখারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসার আগেই মন্ত্রণালয়ের মূল ফটকে বেলা ১২টার দিকে জড়ো হন সচেতন নাগরিক সমাজের সদস্যরা।
তবে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের মন্ত্রণালয়ের গেট থেকে সরানোর চেষ্টা করেনি অথবা বাধা দেয়নি। সমাবেশ শেষ করে বিক্ষোভকারীরা চলে যান।
বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ দক্ষিণ শাখার সদস্য ফরিদ উদ্দিন রতন, আওয়ামী লীগ দক্ষিণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক, প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া ও সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত।
সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা নিহত বাংলাদেশি ফয়সালের ছবি সংবলিত পোস্টার ও ব্যানার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে শ্লোগান দিতে থাকেন। তাঁদের অনেকেই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের সদস্য বলে নিজেদের পরিচয় দেন।
ফরিদ উদ্দিন রতন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে। কিন্তু তাদের দেশে একজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এই হত্যার প্রতিবাদ জানানো হোক।
হাসিবুর রহমান মানিক বেনারকে বলেন, “আমরা ফয়সাল হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছি। এই হত্যার বিচার চাই।”
বিক্ষোভের কিছুক্ষণ পরই মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে আব্দুল মোমেন। বিক্ষোভকারীদের দাবির বিষয়ে বেনারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বেনারকে বলেন, নিহত বাংলাদেশীর বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার তদন্ত করছে। বিষয়টি তদন্তাধীন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কারা, কেন বিক্ষোভ করছে তা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি না কারা এরা।”
মার্কিন সরকারের একজন কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফরের সময় সে দেশের অভ্যন্তরে মানবাধিকার নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ করার কারণে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়তে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “এই ধরনের কাজ উৎসাহব্যঞ্জক নয়।”
বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারী পরিচালক ডোনাল্ড লু ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। এর আগে শনিবার চারদিনের সফরে এসেছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সিনিয়র কর্মকর্তা ও ভারতে আমেরিকান দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লউবেখারের।
বিক্ষোভের বিষয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক ই-মেইল বার্তায় বেনারকে জানায়, “সাঈদ ফয়সালের পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে মার্কিন দূতাবাস। জেলা অ্যাটর্নির মাধ্যমে সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ তদন্তের বিষয়টি আমরা সমর্থন করি।”