বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সংলাপ: ঢাকার অগ্রাধিকার র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার
2022.03.17
ঢাকা
আগামী রোববার অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারিত্ব সংলাপে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে অগ্রাধিকার দেবে ঢাকা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি এবং ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের (আইপিএস) বিষয়ে গুরুত্ব দেবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “এবারের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হবে। যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় সে অনুরোধ জানানো হবে।”
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরপরই বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় কয়েকবার এসেছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশটির সঙ্গে নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও এ বিষয়টি উঠতে পারে।”
“বরাবরই অংশীদারিত্ব সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক আছে সেটা বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়। এবারও তাই হবে,” বলেন তিনি।
আগামী ২০ মার্চের এই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অষ্টম অংশীদারিত্ব সংলাপে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং মার্কিন রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড নিজ নিজ দেশের নেতৃত্ব দেবেন। এ উপলক্ষে ১৯ মার্চ ঢাকা আসছেন ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে দুই বছর বিরতির পর এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
দুই দেশের এই সংলাপ সম্পর্কে ১৫ মার্চ এক ব্রিফিংয়ে মার্কিন দূতাবাসের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কাউন্সেলর সন জে ম্যাকিনটস বলেন, “এ বছর দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করতে যাচ্ছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বহুমাত্রিক এই সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র আরও নিবিড় করতে চায়।”
গুরুত্ব পাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, এই সংলাপের পরে আগামী ৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এরপর ওয়াশিংটনে ৬ এপ্রিল দুই দেশের নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া ১১ মে ঢাকায় দুই দেশের ব্যবসায়ী পরিষদের সভা এবং ১৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে প্রতিরক্ষা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকা বিষয় অনুবিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষভাবে জোর দিচ্ছি আমরা। যুক্তরাষ্ট্রও এ বিষয়ে আগ্রহী।”
তিনি জানান, বৈঠকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গটি তুলতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা (বাংলাদেশ) সব সময় জাতিসংঘের সনদ অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী।”
আসন্ন বৈঠকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ২০১৩ সালে বন্ধ করে দেওয়া অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) ফেরত চাইবে বলে বেনারকে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরী।
“একক দেশ হিসেবে সবচেয় বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সেটা অব্যাহত রাখার জন্য অনুরোধ করা হবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহবানও জানানো হবে।”
প্রায় দুই বছর পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই অংশীদারিত্ব সংলাপ বাংলাদেশের জন্য “সুবর্ণ সুযোগ” বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এহসানুল হক।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যৌক্তিক কিছু উদ্বেগ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এসব বিষয় অ্যাড্রেস করার জন্য এটা একটা দারুণ সুযোগ।”
“তাদের বোঝানো জরুরি যে, যেসব তথ্যের ভিত্তিতে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে তার মধ্যে কিছু দুর্বলতা ছিল। এই স্পর্শকাতর ইস্যু এমন প্লাটফর্মে কূটনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে,” বেনারকে বলেন ড. এহসানুল হক।
তবে তাঁর মতে, “এই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক ডিফাইন করা যাবে না। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বহুমাত্রিক। দুই দেশের সম্পর্ক এর জন্য কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে না।”
মানবাধিকার পরিস্থিতি
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ডিসেম্বরে মার্কিন রাজস্ব বিভাগ ও পররাষ্ট্র দপ্তর র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় এবারের অংশীদারিত্ব সংলাপে মানবাধিকারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
“মানবাধিকার ইস্যু তারা (যুক্তরাষ্ট্র) উত্থাপন করতে পারে। আমরা মনে করি আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুবই ভালো কাজ করছে। তাদের মধ্যে যারা অন্যায় করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তারপরেও যদি তারা (যুক্তরাষ্ট্র) মনে করে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি না; তারা বললে সেটাও আমরা বিবেচনায় নেব,” বলেন সাব্বির আহমেদ চৌধুরী।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, শ্রম অধিকার পরিস্থিতির মতো বিষয় মানবাধিকার আলোচনায় আসবে। এসব বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানাবে বাংলাদেশ।
নিরাপত্তা সহযোগিতা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র কিনতে দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই নিয়ে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশকে জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (জিএসওএমআইএ) ও অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্টের (এসিএসএ) প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
অংশীদারিত্ব সংলাপে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও ভারত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব সাব্বির চৌধুরী।
আইপিএস বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান “নিরপেক্ষ” জানিয়ে সাব্বির চৌধুরী বলেন, “আমরা চাই সবাই এ অঞ্চল ব্যবহার করুক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। সবারই যেন এই এলাকাকে ব্যবহার করার অবাধ উন্মুক্ত এবং সকলের সম্পৃক্ততা থাকে। এখানে কেউ আধিপত্য বিস্তার করবে এই মতামতে আমরা বিশ্বাসী না।”
এছাড়া বৈঠকে “নিরাপত্তা সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা হবে,” বলেও মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে জানান মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তা সন জে ম্যাকিনটস।
তিনি বলেন, “অবাধ ও মুক্ত ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের প্রেক্ষাপটে সংলাপে আইপিএস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি এ বিষয়ে বাংলাদেশের ভাবনাও জানতে চাওয়া হবে।”
আসন্ন এই বৈঠকের বিষয়ে বেনারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে যোগাযোগ করে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
‘জাতিসংঘের উদ্বেগকে উপেক্ষা করছে সরকার’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, গুম ও অন্যান্য মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জাতিসংঘ যেসব উদ্বেগ জানিয়ে আসছে তা উপেক্ষা করছে বাংলাদেশ সরকার।
চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি জাতিসংঘ যে বিষয়গুলোতে উদ্বেগ জানাচ্ছে তা নিয়ে মনযোগী হবার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা পাওয়া র্যাবকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে নিষিদ্ধ করতে আবারো দাবি তুলেছে এই মানবাধিকার সংগঠনটি।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে একটিও ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেনি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাবমতে, ১০ ডিসেম্বরের আগে ২০২১ সালে সারা দেশে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক ক্রসফায়ারে নিহত হন ৫১ জন। এর মধ্যে ৩০ জন মারা যান র্যাবের হাতে।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর বাহিনীটিকে সংস্কারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে গত মাসের শেষ সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “আমরা শুধু নিষেধাজ্ঞায় পড়া ব্যক্তিদের তালিকা পেয়েছি, আলাদা করে কোনো সংস্কার প্রস্তাব পাইনি। তবে যেহেতু র্যাব একটি আইনের অধীনে পরিচালিত হয় সেকারণে তাদের নিয়মিত নানা সংস্কার এবং উন্নতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।”
নিষেধাজ্ঞার পর থেকে দেশে কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি। এর সাথে নিষেধাজ্ঞার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের বাহিনী যদি কোনোভাবে আক্রান্ত হয় তবেই তারা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেটিকে আপনারা ক্রসফায়ার বলছেন। এটা পৃথিবীর সব দেশে আছে।”
তিনি বলেন, “একদিন এমন ঘটনা না ঘটার সাথে নিষেধাজ্ঞার কোনো সম্পর্ক নেই। এমন প্রতিটি ঘটনার পর একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি তদন্ত হয়। তদন্তে যদি দেখা যায় কোনো প্রকার বিচ্যুতি আছে, অবশ্যই তার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হয়।”
তিনি বলেন, “নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণে বেশ কিছু র্যাব সদস্য জেলে আছেন। এটা আমাদের নিয়মিত সংস্কারের অংশ।”