বদলে গেছে বর্ষা মৌসুমের সময়, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি ও অর্থনীতি
2024.10.14
ঢাকা

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে তাপপ্রবাহ শুরু মার্চ মাসের মাঝামাঝি, চলে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। আর মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে জুনের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া বৃষ্টি সেপ্টেম্বরে শেষ হয়। অক্টোবর থেকে শুষ্ক মৌসুমের শুরু হওয়ার কথা।
কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের আবহমান এই আবহাওয়ার প্রকৃতি বদলে গেছে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তাপপ্রবাহ চলছে, বৃষ্টিপাত হচ্ছে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ তাপপ্রবাহ এবং বৃষ্টি দুটোর সময়ই পাল্টে গেছে।
চলতি বছরও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবারও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
কেন অক্টোবর মাসেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে-জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রহমান বেনারকে বলেন, “এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে গত পাঁচ বছর ধরে।”
তিনি বলেন, “দেশের ৭১ ভাগ বৃষ্টি হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। এরপর বৃষ্টি কমতে থাকে এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারি বৃষ্টি থাকে না বললেই চলে।”
“তবে নতুন প্রবণতা অনুযায়ী, তাপপ্রবাহ মার্চের পরিবর্তে জুন-জুলাইয়ে চলে গেছে। এমনকি আগস্ট-সেপ্টেম্বর এবং কিছু অঞ্চলে কখনও ডিসেম্বরের শুরুর দিকেও তাপপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে,” বলেন বজলুর রহমান।
“অন্যদিকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হতে পারে,” মনে করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা।
উদাহরণ হিসাবে এই বজলুর রশীদ বলেন, এ বছরের জুনে শতকরা ২০ ভাগ এবং জুলাইয়ে ১৩ ভাগ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। অন্যদিকে আগস্টে শতকরা ৫০ ভাগ এবং সেপ্টেম্বরে ৩৩ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
চলতি অক্টোবরেও অন্য বছরের তুলনায় বেশি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে বলে জানান এই আবহাওয়াবিদ।
গত বছর অক্টোবরে গড়ে শতকরা ৬৬ ভাগ, নভেম্বরে ১০১ ভাগ ও ডিসেম্বর মাসে ২১২ ভাগ বেশি বৃষ্টি হয় বলে জানান বজলুর রশীদ।

২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের করা এক গবেষণায়ও আবহাওয়ার প্রকৃতি বদলে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর করা এই গবেষণার প্রধান ছিলেন আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রহমান। গবেষণাটি এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করা হয়।
আবহাওয়ার এই পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি থেকে শুরু করে দুযোগ ব্যবস্থাপনাসহ সকল ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. হামিদুর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বৃষ্টির ইতিবাচক দিক হলো, উঁচু জমিতে থাকা আমন ধানের জন্য সেচ প্রয়োজন হচ্ছে না। ফলে এই অসময়ের বৃষ্টি এক শ্রেণির কৃষকের জন্য আশির্বাদ। তাদের সেচের খরচ কিছুটা কমবে। ফলনও ভালো হবে।
তিনি বলেন, “তবে অন্যদিকে নিচু এবং মাঝারি নিচু জমিতে চাষ হওয়া আমন ধান মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় এ ধরনের নিচু জমিতে যে আমন ধান চাষ হতো, সেগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।”
শীতকালীন সবজি উৎপাদনে সবচেয়ে ক্ষতি হবে জানিয়ে ড. হামিদ বলেন, “এবার বৃষ্টির কারণে দেশে সবজি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবজির মাঠ ডুবে গেছে। তাই বাজারে সবজি নেই।”
হামিদুর রহমান বলেন, “এরপর যা হবে কৃষকরা শীতের মধ্যে সবজি চাষ করবেন এবং তখন একসাথে প্রচুর সবজি বাজারে উঠবে এবং দাম কমে যাবে। তাতে ভোক্তা লাভবান হলেও কৃষকরা নায্যমূল্য পাবেন না। সার্বিকভাবে কৃষি ও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, যা কখনই কাম্য নয়।”
কৃষিবিদ ড. হামিদ বলেন, “গতবছরও নভেম্বর, ডিসেম্বরে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। ফলে আলু এবং পিঁয়াজ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে এসব পণ্যের দাম এখনও চড়া।”
এভাবে আবহাওয়া পরিবর্তিত হতে থাকলে আমাদের কৃষি নিয়ে নতুন করে কৌশল বের করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
মিরপুর সিরামিক এলাকার বাসিন্দা মো. মোস্তফা সোমবার বেনারকে বলেন, “কেবল পেপে, পটল ও মিষ্টি কুমড়া ছাড়া প্রায় সব সবজির দাম প্রতি কেজি ১০০ টাকার বেশি। এই সময়ে তো নতুন ফুলকপি, বাধাকপিসহ শীতের নতুন সবজি উঠতে থাকার কথা। কিন্তু কিছু নেই। বাজারে শুধু গ্রীষ্মকালীন সবজি ছাড়া কিছু নেই।”
মিরপুর-১২ এলাকার সবজি ব্যবসায়ী ও মানিকগঞ্জ জেলার বাসিন্দা আব্দুল মালেক সোমবার বেনারকে বলেন, “আমি যার কাছে সবজি কিনে আনি তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে ঢেড়স চাষ করেন। যেখানে কয়েক মণ ঢেড়স উৎপাদন হওয়ার কথা সেখানে উৎপাদন হয় ২০ কেজি। তাই, সবজির দাম বেশি। বাজারে আপনি সবজি পাবেন না।”
অসময়ে অতিবৃষ্টির কারণে দেশের বিভিন্ন অংশে বন্যা দেখা দিচ্ছে। গত মাসে দেশের বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে হঠাৎ বন্যা দেখা দেয়। সেখানকার কৃষি থেকে শুরু করে মানুষের বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে তিস্তার পানি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর রংপুর জেলায় ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। ফসলসহ বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার প্রভাব সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে পড়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আব্দুল লতিফ খান সোমবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশি বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটছে এবং সেটি হয়তো ঘটতে থাকতে পারে। এর কারণ জলবায়ু পরিবর্তন বলা যায়, যদিও আমাদের এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে।”
বাংলাদেশে স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে সেটিকে মোকাবিলা করতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাজে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
আব্দুল লতিফ খান বলেন, “বাংলাদেশে যে পরিমাণ পানি আসে তার শতকরা সাত ভাগের বেশি দেশের মধ্যে থেকে আসে। বাকি ৯৩ ভাগ আসে নেপাল, ভূটান ও ভারত থেকে। সুতরাং, আমাদের ওই সকল দেশগুলোতে কি পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে তার ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে।”
উদাহরণ হিসাবে লতিফ খান বলেন, “এ বছর প্রথমবারের মতো কাঠমুন্ডু ভ্যালিতে বন্যা হয়েছে। এই বন্যার প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। সেই পানি গঙ্গা নদী দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী এলাকা দিয়ে প্রবেশ করবে এবং আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে বন্যা সৃষ্টি করবে। কিন্তু আমরা এখনও পর্যন্ত সেরকম পূর্বাভাস আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে দেখিনি।”