ড. ইউনূসের মামলা পর্যবেক্ষণে আসতে চান আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা
2024.01.30
ঢাকা

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচারিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে আসতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বব্যক্তিত্বরা।
ড. ইউনূসকে হয়রানি করা হচ্ছে মর্মে উদ্বেগ জানিয়ে গত বছরের আগস্টে ১০০ নোবেল বিজয়ী ব্যক্তি ও বিভিন্ন দেশের ৬০ জন বিশিষ্ট নাগরিক চিঠি দেওয়ার পরে বিচারিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে আসতে তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
ড. ইউনূসের ‘ধারাবাহিক বিচার বিভাগীয় হয়রানি ও কারাদণ্ড’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর ১২৫ নোবেল বিজয়ীসহ ২৪২ বিশ্বব্যক্তিত্ব একটি খোলা চিঠি লিখেছেন।
চিঠিটি ২৮ জানুয়ারি ‘প্রটেক্ট ইউনূস ডট ওয়ার্ডপ্রেস ডটকম’ ওয়েবসাইটে এবং ২৯ জানুয়ারি মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয়েছে।
এর আগেও ড. ইউনূস প্রসঙ্গে গত বছরের মার্চে ও আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর খোলা চিঠি লিখেছিলেন এই বিশ্বব্যক্তিত্বরা।
মঙ্গলবার এই চিঠি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ইউনূসের মামলায় সরকার কোনো পক্ষ নয়। যেসব শ্রমিক-কর্মচারীরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁরাই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত খোলা চিঠি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটি ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারে ছাপা হয়েছে, নিউজ আকারে নয়। এটা একদম স্পষ্ট যে, লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকারে সেটি ছাপানো হয়েছে।”
যা আছে খোলা চিঠিতে
১২৪ জন নোবেল বিজয়ীসহ মোট ২৪২ বিশ্বব্যক্তিত্বের লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমরা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অব্যাহত হয়রানি এবং সম্ভাব্য জেলে যাওয়ার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখছি। আমরা মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষার জন্য জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারের আইরিন খানের সঙ্গে একমত; যিনি গত ১ জানুয়ারি, ২০২৪-এ রায়টিকে ‘বিচারিক প্রতারণা’ বলে অভিহিত করে আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।”
চিঠিতে আরও বলা হয়, “আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, দ্রুত আইনি প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশের আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হয় সেই ধারাবাহিকতার অভাব।”
“ফৌজদারি রায়ে ৮৩ বছর বয়সী অধ্যাপক ইউনূসসহ অলাভজনক সংস্থা গ্রামীণ টেলিকমের চার বোর্ড সদস্যকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অথচ তাঁদের সামান্য জরিমানাও করা যেত,” বলা হয় চিঠিতে।
বিশ্বব্যক্তিত্বদের এই চিঠিতে আরও বলা হয়, আমরা আরও লক্ষ করেছি, গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিরোধী নেতাদের দমন ও কারাবরণ এবং মিডিয়া ও স্বাধীন মতের ওপর ক্র্যাকডাউন চলানো হয়েছে; যা বাংলাদেশের ও দেশের বাইরের অনেক মানবাধিকার-গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে নথিভুক্ত করেছে।
“পূর্ববর্তী চিঠির জবাবে আপনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, স্বাক্ষরকারীদের উচিত বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীদের পাঠিয়ে দেখা—এখানে কোনো অন্যায় হয়েছে কি না বা মামলাটি অন্যায়ভাবে করা হয়েছে কি না। আমরা আপনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। ”
শ্রম আইনের যে মামলার রায় ১ জানুয়ারি দেওয়া হয়েছে শুধু সেটিই নয়, একইসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের বর্তমান তদন্তও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন বলে তাঁরা মত দেন।
“আমরা এই পর্যালোচনা পরিচালনার জন্য স্বাধীন আইন বিশেষজ্ঞদের একটি ছোট দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক আইনজীবীকে প্রস্তাব করতে চাই। আমরা অবিলম্বে এই কাজ শুরু করতে চাই এবং অনুরোধ করব, অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের জন্য যে কোনো সাজা এই পর্যালোচনা চলা পর্যন্ত মুলতবি করা হবে,” বলা হয় চিঠিতে।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, আপনি জানেন, অধ্যাপক ইউনূস ২৪টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬১টি সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। তাঁর সামাজিক ব্যবসা কেন্দ্র ৩৯টি দেশের ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি ১০টি দেশের জাতীয় সম্মানসহ ৩৩টি দেশ থেকে ১৩৬টি পুরস্কার পেয়েছেন।
অধ্যাপক ইউনূস ইতিহাসে সাতজন ব্যক্তির মধ্যে একজন, যিনি একাধারে নোবেল শান্তি পুরস্কার, ইউনাইটেড স্টেটস প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ইউনাইটেড স্টেটস কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন।
ইউনূসকে সারা বিশ্ব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্য হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন, বর্জ্য নিঃসরণ, সামাজিক ব্যবসা, স্বাস্থ্যসেবা ও দরিদ্রদের জন্য শিক্ষা এবং সামাজিক ও পরিবেশগত অগ্রগতিতে অবদান, ক্রীড়া ক্ষেত্রে গতিশীলতার জন্য তাঁর মতো সক্রিয় নেতৃত্বের অত্যন্ত প্রয়োজন।
“তিনি (ইউনূস) সক্রিয়ভাবে আমাদের অনেক দেশে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। দুর্বল অভিযোগে তাঁকে কারাবাস করতে হলে বিশ্বের জন্য তা হবে একটি বড়ো ক্ষতি,” বলা হয় চিঠিতে।
সরকার তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করছে তা সব জায়গা থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হওয়া উচিত নয়।
“দ্রুতই এই প্রহসনের অবসান ঘটিয়ে আমরা আপনাকে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা সমুন্নত রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি,” বলা হয় চিঠির শেষ অংশে।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, শান্তিতে নোবেলজয়ী বারাক ওবামা, হোসে রামোস-হোর্তা, মাইরেড কোরিগান-ম্যাগুয়ার, অস্কার আরিয়াস সানচেজ, কার্লোস ফিলিপে জিমেনেস বেলো, জোডি উইলিয়ামস, শিরিন এবাদি, মোহাম্মদ এলবারাদেই, আলবার্ট আর্নল্ড গোর জুনিয়র, লেইমা রবার্টা জিবোয়ি, তাওয়াক্কোল কারমান, জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস, ডেনিস মুকওয়েগে, নাদিয়া মুরাদ, দিমিত্রি মুরাটভ ও মারিয়া রেসা।
গত ১ জানুয়ারি গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে সরকারের করা মামলায় ইউনূসসহ কোম্পানিটির আরও তিন কর্মকর্তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত।
ড. ইউনূস ছাড়াও এই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন—গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল হাসান, পরিচালক নূরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান।
ইউনূসের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযোগপত্র
গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারী কল্যাণ তহবিল থেকে ২৫ কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইউনূসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলায় সোমবার অভিযোগপত্র অনুমোদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এক সংবাদ সম্মেলনে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, তদন্ত শেষে এই মামলায় অভিযোগপত্র অনুমোদন করা হয়েছে। এখন বিচারিক কার্যক্রম শুরুর জন্য আদালতে পাঠানো হবে।
সরকার কোনো পক্ষ না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত স্বাধীন, শ্রমিক-কর্মচারীরাই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
রাজধানীর বেইলী রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মঙ্গলবার ১৪টি দেশের অনিবাসী রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারবৃন্দ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
হাছান মাহমুদ বলেন, “ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবের প্রতি যথাযথ সম্মান এবং শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই যে, বাংলাদেশে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ বিধায় সরকারি দলের অনেককে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়, জেলেও যায় এবং ইউনূস সাহেবের এই মামলায় সরকার কোনো পক্ষ না। ”
মামলা শ্রমিকরা করেনি: ড. ইউনূস
চলতি বছরের প্রথম দিন শ্রম আদালত ঘোষিত রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকার কাকরাইলে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে গত রোববার আপিল করেছেন অধ্যাপক ইউনূস। রায়ের দিনই ন্যায় বিচার পাননি বলে নিজের হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, “সাজা কী দেবে-না দেবে, এগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমাদের। আমরা নতুন পৃথিবী গড়ব। সাজা-অসাজা ছোট্ট জিনিস, আমি বৃহত্তর ছকের মধ্যে আছি। আমার প্রত্যাশা হচ্ছে, আমরা নতুন পৃথিবী গড়ব। আমরা তিন শূন্যের পৃথিবী গড়ব। থ্রি জিরো ওয়ার্ল্ড (শূন্য বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও শূন্য বেকারত্ব)।”
এ সময় তিনি বলেন, সরকার বারবার বলছে, মামলাটি সরকার করে নাই। এটা (মামলা) কি সরকার করল, না শ্রমিকরা করল? কলকারখানা অধিদপ্তর সরকারের অধিদপ্তর, সে করেছে। শ্রমিকরা করে নাই।”