ড. ইউনূসের অভিযোগ, তাঁর আট প্রতিষ্ঠানের দখলে বহিরাগতরা

আহম্মদ ফয়েজ
2024.02.15
ঢাকা
ড. ইউনূসের অভিযোগ, তাঁর আট প্রতিষ্ঠানের দখলে বহিরাগতরা ঢাকার মিরপুরে গ্রামীণ টেলিকম ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।
[জীবন আহমেদ/বেনারনিউজ]

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস অভিযোগ করেছেন, বর্তমানে সরকার নিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকই তাঁর ১৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আটটির ফটকে জোরপূর্বক তালা লাগিয়েছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে তালা লাগানোর ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকার মিরপুরে টেলিকম ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমরা অনেক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাই। আমি এমন বিপর্যয় দেখিনি যে হঠাৎ করে বাইরে থেকে কিছু লোক এসে আপনাকে সরে যেতে বলেছে।”

সংবাদ সম্মেলনটি দুপুর ১২টায় নির্ধারিত থাকলেও এটি প্রায় ৩০ মিনিট পরে শুরু হয়, কারণ অজ্ঞাতপরিচয় কিছু লোক ভবনের সামনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। ঝাড়ু হাতে কিছু নারীকে ভবনের সামনে অবস্থান করতে দেখা যায়। তাঁদের কেউ কেউ ড. ইউনূসের কাছে টাকা পান বলে দাবি করেন।

এ সময় আশপাশে বেশ কিছু পুলিশ সদস্যকেও উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। এই ভবনটিতে মোট ১৮টি কোম্পানি রয়েছে, যার প্রত্যেকটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউনূস।

“আমরা একটি ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি,” উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, “আমরা খুব সম্প্রতি এই সুন্দর ভবনটি নির্মাণ করেছি। আমরা যখন গ্রামীণ ব্যাংকে ছিলাম তখন আমাদের অফিস সেখানে ছিল। অফিস থেকে বের হওয়ার সময় হলে আমরা ভাবলাম সবাই মিলে একটা বিল্ডিং বানাব যেখানে আমরা শান্তিতে কাজ করতে পারব। ...এটা আমাদের স্বপ্নের বীজতলা।”

“হঠাৎ চার দিন আগে (১২ ফেব্রুয়ারি) আমরা দেখলাম বহিরাগতরা এসে জোর করে আমাদের অফিসের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। আমরা তাদের কাছে বহিরাগত হয়ে গেলাম। তারা তাদের মতো করে অফিসগুলো চালানোর চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারছি না এটা কী হচ্ছে!,” বলেন ইউনূস।

পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ

পুলিশের কাছে ঘটনাটি জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি মন্তব্য করে, সম্প্রতি শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাসের জন্য দোষী সাব্যস্ত নোবেল বিজয়ী ইউনূস আরও বলেন, “আমরা পুলিশকে বলেছিলাম যে আমাদের অফিসে এমন একটি ঘটনা ঘটছে। আপনারা এসে দেখেন এবং সমাধান করেন। পুলিশ প্রথমে আমাদের অভিযোগ গ্রহণ করেনি। তারপর তারা একবার এসেছিল। কিন্তু তারা কোনো সমস্যা দেখেনি, যদিও আমরা তাদের অনুরোধ করেছিলাম যে আমাদের দরজা কিছু লোক তালা দিয়ে রেখেছে তা দেখার জন্য।”

তিনি জানান, যেসব বহিরাগত ব্যক্তি নিজেদের গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক মনোনীত নতুন চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল তারাই এখন প্রতিদিন সকালে দরজা খুলে কর্মচারীদের অফিসে ঢুকতে দেয়।

“দেশের আইন-আদালত কোথায় গেল? সকাল থেকে এখানে (টেলিকম ভবনের সামনে) ঝাড়ু নিয়ে মিছিলের কথা শুনলাম। আমি বুঝতে পারছি না কেন! আমরা হঠাৎ করেই ঝাড়ুর যোগ্য হয়ে গেলাম!” বলেন ইউনূস।

“আমাদের সবগুলো কোম্পানির হেড অফিস আমরা এখানে তৈরি করেছি। যাঁরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা সারাজীবন কাজ করেছেন এটাকে সফল করতে এবং দেশের মানুষের কল্যাণে,” যোগ করেন তিনি।

ভবনের প্রতিটি কোম্পানি ব্যবসার মুনাফার ওপর গড়ে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে গ্রামীণ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কোনো এখতিয়ার নেই।

“এই প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় গড়ে ওঠেনি,” বলে নিজের হতাশা ব্যক্ত করে ইউনূস বলেন, “আমি এখন কোথায় যাব!”

বহিরাগতরা দখল নিয়েছে যে আট প্রতিষ্ঠান

ড. ইউনূসের গড়া যে আটটি প্রতিষ্ঠান বহিরাগতরা তালা দিয়েছে সেগুলো হচ্ছে; গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ শক্তি এবং গ্রামীণ কমিউনিকেশনস।

এই পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি।

অভিযোগ সম্পর্কে জানার জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল মজিদকে বেনারের পক্ষ থেকে ফোন করে ও টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েও কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শাহ আলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার বিষয়টি তদন্ত করছেন। তবে তিনি এখন ছুটিতে রয়েছেন।

তিনি বলেন, “এটা স্পর্শকাতর বিষয়। এ বিষয়ে আমি আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।”

গত ১ জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি আদালত ৮৩ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের আরো ৩ সহকর্মীকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়, যা ছিল কোনো মামলায় ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রথম সাজা।

হাইকোর্ট অবশ্য ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের স্থায়ী জামিন মঞ্জুর করেছে।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এই চারজনকে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালকে না জানিয়ে বিদেশ সফরে না যাওয়ার নির্দেশ দেয়।

ক্ষুদ্র ঋণের অগ্রদূত হিসাবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছিল। ২০১১ সালে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবসরের বয়স সংক্রান্ত ইস্যুতে ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়।

জটিলতা যেভাবে সৃষ্টি

গত ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ টেলিকম ও কল্যাণের কাছে সাতটি অফিস আদেশ পাঠানো হয়েছে । এসব আদেশে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকমের আর্টিকেল অব এসোসিয়েশনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী মাসুদ আখতার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের কনসালট্যান্ট মোহাম্মদ জিম জোবায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মো. গোলাম জাকারিয়া রহমানকে গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালক হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। একইসাথে গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল মজিদকে গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।

ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যবসার গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলো কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর অধীনে নিবন্ধিত প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। সে সময় এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধিত্ব রাখার সুযোগ রাখা হয়। এই বিধানের আওতায় গ্রামীণ ব্যাংক ১৯৯৫ সালে গ্রামীণ টেলিকম ও ১৯৯৬ সালে গ্রামীণকল্যাণে প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে ড. ইউনূসকে মনোনয়ন দেয়। এছাড়া পরিচালক পদে কয়েকজনকে মনোনয়ন দেয়।

গত ২৭ বছর পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান পদে আর কাউকে মনোনয়ন দেয় নি গ্রামীণ ব্যাংক। তবে পরিচালক পদে মনোনয়ন দেয়া হয়।

গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ২০০৯ সালের ওই ধারা বাদ দিয়ে সংশোধন করা হয় এবং বিষয়টি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিকে নিয়ম অনুযায়ী জানানো হয়। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২০০৯ সালের ওই সংশোধনী তারা পাননি।

জবরদখলের অভিযোগ অস্বীকার

এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গ্রামীণ ব্যাংক দাবি করেছে, সাম্প্রতিক বোর্ড সভায় আইন অনুযায়ী গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণসহ সাতটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে।

ব্যাংকটির মিডিয়া সেলের প্রধান আঞ্জু আরা বেগম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, “ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংবাদ সম্মেলনে বেশ কিছু বিভ্রান্তিমূলক, অসত্য, বেআইনি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য দিয়েছেন।”

গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠান জবরদখলের অভিযোগ অস্বীকার করে এতে বলা হয়, ওই দিন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা ১৫৫তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে “নিয়ম মেনে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের চিঠি হস্তান্তর করেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।