ড. ইউনূসের জামিন ও বিচারের স্বাভাবিক গতি নিয়ে আইনজীবীর সংশয়
2024.07.03
ঢাকা

শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জামিন ও বিচারের স্বাভাবিক গতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তাঁর আইনজীবী।
বৃহস্পতিবার ড. ইউনূসসহ চারজনের জামিনের মেয়াদ শেষ হবে। এর একদিন আগে বুধবার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের আগে দেয়া সাজার রায় স্থগিত বিষয়ক আদেশ বাতিল করে হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ ও তাতে থাকা কিছু নির্দেশনা নিয়ে আইনজীবীর এই সংশয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে ড. ইউনূসের আপিল ‘যত দ্রুত সম্ভব’ নিষ্পত্তি করতেও বলা হয়েছে বলে জানান আইনজীবীরা।
ড. ইউনূসসহ চারজনের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুনের আশঙ্কা, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে পূর্ব নির্ধারিত আপিল শুনানির আগের দিন হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ বিচারিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে।
বৃহস্পতিবার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল শুনানিতে ড. ইউনূসসহ দণ্ডপ্রাপ্তদের স্থায়ী জামিন চাওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আপিল ট্রাইব্যুনাল জামিন না দিলে ড. ইউনূসসহ অন্যদের জেলে যেতে হবে। আপিল মামলায় আসামিরা হয় জামিনে থাকবেন অথবা কারাগারে থাকবেন।”
“কিন্তু হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় এমন সময় প্রকাশ করা হলো, যখন আমরা হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলও করতে পারব না,” যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল হলো শ্রম আইন সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির সর্বোচ্চ আদালত। হাইকোর্ট থেকে যখন বলা হয়, ড. ইউনূসের মামলা তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করা হোক; তখন বলা যায় যে, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের হাত বেঁধে ফেলা হলো। এখানে স্বাভাবিক গতিতে বিচার প্রক্রিয়া চলবে কি না সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়।”
এই রায়ের ফলে ড. ইউনূসসহ অন্যান্যদের “বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে,” মন্তব্য করে তিনি অভিযোগ করেন, “রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে এই রায় দিতে ভূমিকা রেখেছে।”
উচ্চ আদালত রায়ে বলেছে, কারো ‘কনভিকশন’ বা দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার রায় কখনো বাতিল হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, “কথাটি ঠিক, কিন্তু আমরা তো শ্রম আপিল ট্রাইবুনালে কনভিকশন বাতিল চাইনি। আমরা সেনটেন্স (দণ্ড) বাতিল চেয়েছি।”
‘আদালত সরকারের নির্দেশে চলে না’
এদিকে ড. ইউনূসের আইনজীবীর এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বেনারকে বলেন, “আদালত তো আর সরকারের নির্দেশে চলে না। রিভিশন মামলা শুনানির সময় হাইকোর্টে ড. ইউনূস সাহেবের আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। তাঁর কথা শোনার পরই আদালত বুধবার মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন।”
ড. ইউনূসের আইনজীবী বিষয়টিকে শুধু “জটিল করে অসত্য কথা বলে বেড়াচ্ছেন,” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উল্লেখ্য, শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলায় চলতি বছরের ১ জানুয়ারি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইউনূস ও তিনজনকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয় ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত।
দণ্ডিত অন্য তিনজন হলেন—গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও মো. শাহজাহান।
গত ২৮ জানুয়ারি ওই রায়ের বিরুদ্ধে ড. ইউনূসসহ চারজন আপিল করেন। ওই দিনই শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল আপিলটি শুনানির জন্য গ্রহণ করে চারজনকে জামিন দেন।
এদিকে মামলার বাদী শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের আদেশের বৈধতা নিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন। সেই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে পর দিন হাইকোর্ট রুল দেয়।
গত ১৮ মার্চ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের আদেশ বাতিল করে। বুধবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত এক হাইকোর্ট বেঞ্চ সেই রায় সুপ্রিমকোর্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে অনেক বিষয়ের সাথে ড. ইউনূসের দায়ের করা আপিল মামলা “মেরিট বিবেচনা করে যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি” করতেও বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ড. ইউনূসের হাতে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ট্রাস্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমে বাংলাদেশ শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি শ্রম আদালতে মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান।
অভিযোগ আনা হয়, শ্রম আইন অনুযায়ী গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকদের জন্য শতকরা পাঁচ শতাংশ লভ্যাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা দেওয়া হয়নি, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করা হয়নি, গণছুটি নগদায়ন করা হয়নি—আইনত যা অপরাধ।
তবে ড. ইউনূস বারবার বলে আসছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা, অসত্য এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলাফল।
২০০৭ সালে নাগরিক শক্তি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন ড. ইউনূস। তবে কয়েক মাস পর সেই সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সরে আসেন। ওই সময়ে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর তার সমর্থন থাকার কথা ২০০৯ সাল থেকে বলে আসছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
বিশ্বব্যাংক থেকে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে ড. ইউনূস ভূমিকা রেখেছেন বলে অসংখ্যবার বক্তব্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন ড. ইউনূস।