উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে বাংলাদেশ-চীন প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.01.15
ঢাকা
201015_Bangladesh-China-Centre_1000.jpg পূর্বাচলে নির্মাণাধীন বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রের সামনে একজন বাংলাদেশি শ্রমিক দাঁড়িয়ে আছেন। ১০ জানুয়ারি ২০২০।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে বাংলাদেশের প্রথম স্মার্ট সিটি পূর্বাচলে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ অব্যাহত রয়েছে।

একাধিক মানবাধিকার ও পরিবশেবাদি সংগঠনের জনস্বার্থে দায়ের করা মামলার রায়ে হাইকোর্ট পূর্বাচলে চীন-বাংলাদেশ প্রদর্শনী কেন্দ্রের নির্মাণ অবৈধ ঘোষণা করে।

আপিল বিভাগ থেকেও কেন্দ্রটি নির্মাণ অবৈধ হিসেবে রায় দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক বেনারের কাছে স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণে আদালত অনুমোদন দেয়নি।

আদালতে রায়ের একটি কপি বেনারের কাছে রয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, পূর্বাচল প্রকল্পে শুধুমাত্র ‘আইকনিক টাওয়ার’ ছাড়া অন্য কোনো বাড়তি ভবন নির্মাণ করা যাবে না।

চীন-বাংলাদেশ প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “কাজ প্রায় শেষ। এ বছর জুলাই মাসের মধ্যে কেন্দ্রটি উদ্বোধন করার সম্ভাবনা রয়েছে।”

প্রদর্শনী কেন্দ্রে যা থাকবে

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় দেশের প্রথম স্মার্ট সিটি পূর্বাচল উপশহর বাস্তবায়ন করছে। আধুনিক নাগরিক সুবিধার সবকিছু থাকায় এটির নাম দেওয়া হয়েছে স্মার্ট সিটি।

এর একটি অংশ গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড়কাউ ও পারাবার্থ মৌজায় পড়েছে।

চাইনিজ স্টেট কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন পূর্বাচলে প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ করছে। কেন্দ্রের পরিচালক রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “পূর্বাচল শহর প্রকল্পের কেন্দ্রে চীন-বাংলাদেশ প্রদর্শনী কেন্দ্রটি স্থাপন করা হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম প্রদর্শন করবে। এখানে সারা বছর ধরে বিভিন্ন প্রদর্শনী চলবে।”

তিনি বলেন, “এক তলা কেন্দ্রটি ২৬ একর জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে কেন্দ্রটির পরিসর আরও বৃদ্ধি করা।”

রাজউক কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের মোট খরচ ১৩০৩ কোটি টাকার মধ্যে চীন অনুদান হিসেবে দিচ্ছে ৬২৫ কোটি টাকা, বাকিটা বহন করছে বাংলাদেশ।

রেজাউল করিম বলেন, “চীনা অংশের কাজ প্রায় শেষ। চীন-বাংলাদেশ প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ কাজের জন্য চীন সরকার ৬২৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। এই টাকা ফেরত দিতে হবে না।”

বাংলাদেশ অংশের মধ্যে বহুতল পার্কিং এবং আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থা থাকবে বলে জানান রেজাউল করিম।

প্রসঙ্গত, পূর্বাচলের পানি সরবরাহের কাজ করছে চীনা কোম্পানি। এ ছাড়া রাজউকের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় স্মার্ট শহর এবং দেশের প্রথম পানি-ভিত্তিক শহর বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা ও প্রতিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা নিখরচায় সম্পন্ন করছে একটি চীনা কোম্পানি।

বেনারনিউজ প্রতিনিধি গত শুক্রবার চীন-বাংলাদেশ প্রদর্শনী কেন্দ্রটির স্থান সরেজমিন পরিদর্শন করেন। অনুমতি চাইলে প্রবেশ গেটে দায়িত্বপ্রাপ্ত চীনা কর্মকর্তা প্রবেশ করতে দেননি। তিনি বেনারের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।

সেখানে কর্মরত মো. আক্কাস নামের এক শ্রমিক বেনারকে বলেন, “কাজ প্রায় শেষ। আমি এখানে কয়েক বছর ধরে কাজ করি। প্রতিদিন ৬০০ টাকা মজুরি দেয়। এখানে প্রায় একশর বেশি চীনা শ্রমিক কাজ করে।”

পরিবেশ রক্ষায় মামলা

২০১৩ সালে রাজউকের পূর্বাচলের ডিজাইন পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করে সাতটি মানবাধিকার ও পরিবেশিবাদি সংগঠন, যার নেতৃত্বে ছিল আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)।

আসকের মতে, পূর্বাচল প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান, জলাধার রক্ষা আইন, বন আইনসহ মোট সাতটি আইনের লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

২০১৪ সালের ১১ মার্চ হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, আদালতের অনুমতি ছাড়া কোনোভাবেই প্রকল্প এলাকার বন, হ্রদ, শহুরে বন, উদ্যান, খেলার মাঠ, সবুজ এলাকা ও অন্যান্য পরিবেশগত খালি জায়গা নষ্ট করতে পারবে না রাজউক। কিন্তু সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নেতৃত্বে সাতটি সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন দাখিল করে।

এতে বলা হয়, আদালতের নির্দেশনার বাইরে গিয়ে খোলা জায়গা, খেলার মাঠ, বন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য ভূমি পরিবর্তন করে পূর্বাচলে আরও বাণিজ্যিক প্লট তৈরি করছে রাজউক।

“আমরা পূর্বাচল প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করি। কারণ এ প্রকল্পের কারণে সেখানকার ১১ লাখ গাছ কাটা পড়বে, সেখানকার বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে,” বলেন রিজওয়ানা হাসান।

এদিকে রাজউকের আইনজীবী তানজিবুল আলম আদালতের কাছে পূর্বাচলের কেন্দ্রস্থলে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্র এবং আইকনিক টাওয়ার নামে বহুতল ভবন স্থাপনের অনুমতি চান।

দুপক্ষের শুনানির পর গত বছর ১০ অক্টোবর আপিল বিভাগ রায়ে জানায়, “নির্বিচারে গাছ কেটে ও হ্রদ, পুকুর, জলাধার ভরাট করে ওই এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে।”

“শুধু আইকনিক টাওয়ার নির্মাণ করা যেতে পারে,” রায় দিয়ে আদালত বলে, এই টাওয়ার নির্মাণে ওই এলাকার প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা যাবে না।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আদালত শুধু আইকনিক টাওয়ার ছাড়া চীন-বাংলাদেশ প্রদর্শনী কেন্দ্র এবং ওয়্যারহাউজ নির্মাণকে অবৈধ ঘোষণা করে। সেই রায় আজ পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়নি। ‍সুতরাং, চীন-বাংলাদেশ প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ করা অবৈধ।”

রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক বেনারকে বলেন, “আদালত তার রায়ে চীন-বাংলাদেশ প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ অনুমোদন করেননি। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছি।”

তিনি বলেন, “আমরা আশা রাখি আপিল বিভাগ চীন-বাংলাদেশ প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণকে বৈধ ঘোষণা করবে।”

তবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে কেন ভবনটি নির্মাণ অব্যাহত রাখা হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছু বলেননি।

উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এই কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।