বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে চীনা কোম্পানি, ক্রেতা সরকার
2020.11.12
ঢাকা

দেশে প্রথমবারের মতো বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে একটি চীনা কোম্পানিকে কাজ দিয়েছে সরকার।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের সভাপতিত্বে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বৃহস্পতিবার এই প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে বলে জানান মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু সালেহ মোস্তফা কামাল।
তিনি জানান, চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (সিএমইসি) নিজস্ব বিনিয়োগে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করবে এবং সরকার তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনবে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ১৮ দশমিক ২৯৫ টাকা।
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি), বিদ্যুৎ বিভাগ ও সিএমইসি চুক্তি স্বাক্ষর করবে বলে জানান আবু সালেহ। তবে কবে নাগাদ চুক্তি স্বাক্ষর অথবা প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
তবে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের দেড় বছরের মধ্যেই প্রকল্পটি চালু হবে বলে গত ২২ আগস্ট আমিনবাজারে প্রকল্পের সম্ভাব্য স্থান সফর শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের প্রধান অংশীদার চীন। দেশের বৃহত্তম কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ ছাড়াও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে চীনের সাথে চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। এখন বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ পেল চীনা প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পটির সারমর্ম অনুযায়ী, এই প্রকল্প থেকে দৈনিক ৪২ দশমিক পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে সিএমইসি। বেনারের হাতে এর একটি কপি রয়েছে।
প্রকল্পের জন্য ডিএনসিসি বিনামূল্যে ৩০ একর জমি দেয়া ছাড়াও নিজস্ব খরচে দৈনিক তিন হাজার মেট্রিকটন বর্জ্য দেবে। প্রকল্পের মেয়াদ হবে ২৫ বছর।
এই সময়ে বিদ্যুৎ কেনার বিপরীতে সিএমইসি–কে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থাৎ দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ দিতে হবে বাংলাদেশকে। তবে বিদুৎ কেনা ছাড়া এই খাতে বাংলাদেশের অন্য কোনো খরচ নেই।
বর্জ্য এক বিরাট সমস্যা
সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বেশি হলেও ঢাকার ক্রমবর্ধমান বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই প্রকল্প।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ঢাকা শহরে দুই কোটির বেশি মানুষ বসবাস করেন। শহরের ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় হাজার মেট্রিকটন বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
এগুলো রাজধানীর উপকণ্ঠে আমিনবাজার ও মাতুয়াইলের নিচু ভূমিতে সরাসরি ফেলে দেওয়া হয়। এই আবর্জনা নদী, নালা, খালসহ অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান বেনারকে বলেন, “প্রতিদিন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তিন হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এই বর্জ্য আমাদের বিভিন্ন নিচু জায়গায় ফেলে দেয়া হচ্ছে, যা বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করছে।”
এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাথে তিন হাজার মানুষ জড়িত জানিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমানে এক টন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এক হাজার ৭৬০ টাকা ব্যয় হয় (কুড়ি দশমিক সাত মার্কিন ডলার)। এক দিনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য খরচ হয় ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।”
সেই হিসাবে আগামী ২৫ বছরে ঢাকা উত্তর সিটিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কমপক্ষে ৫৭৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ব্যয়ও প্রায় একইরকম।
“এই বর্জ্যের কারণে ঢাকায় মারাত্মক দূষণ দেখা দিয়েছে। নদী, নালা, খাল দূষিত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে। যারা এই বর্জ্য নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের স্বাস্থ্য সমস্যা হচ্ছে। সে কারণে পরিবেশসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দরকার,” বলেন সাইদুর রহমান।
তিনি বলেন, “যদি বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় সেক্ষেত্রে বর্জ্য আর ফেলতে হবে না। আবার বিদ্যুতের পাশাপাশি সারও উৎপাদন করা যাবে।”
দেশের প্রথম বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ প্রকল্প
বাস্তবায়িত হলে এটিই দেশের প্রথম বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উপাদন প্রকল্প হবে বলে বেনারকে জানান বিদ্যুৎ সচিব ড. সুলতান আহমেদ।
তিনি বলেন, “উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম কিছুটা বেশি বলা যায়। কিন্তু এর পেছনে কারণ আছে।”
তিনি বলেন, “প্রথম কথা হলো, এখানে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে সেটি ইউরোপীয় মানের। এই প্রযুক্তির খরচ বেশি। তা ছাড়া চীনা কোম্পানিকে অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। সেটিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।”
বিদ্যুৎ সচিব বলেন, “সরকার এখানে কোনো বিনিয়োগ করবে না। চীনা কোম্পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে সরকার সেটি কিনে নিয়ে বিদ্যুতের দাম দেবে।”
তাঁর মতে, “এই প্রকল্পটি শুধু অর্থ দিয়ে বিবেচনা করলে চলবে না। এর সাথে আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল, ভূমিসহ সার্বিক পরিবেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এই বর্জ্য থেকে সার উৎপাদন করা যাবে। এই প্রকল্প আমাদের ভীষণভাবে প্রয়োজন।”
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনা কোম্পানি কত টাকা ব্যয় করবে—এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব কিছু জানাননি।
তিনি বলেন, “আমরা আশা করি যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।”
বাংলাদশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ম. তামিম বেনারকে বলেন, “বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নেই। তবে এটি কিন্তু ব্যয়বহুল হবে। যেখানে ভোক্তা পর্যায়ে ছয় থেকে সাড়ে ছয় টাকা প্রতি কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ বিক্রি হচ্ছে, সেখানে এই প্রকল্পের বিদ্যুৎ ১৮ টাকার ওপরে কিনতে হবে, যা অনেক বেশি।”
“উচ্চমূল্যের কারণে এ ধরনের প্রকল্প কতটুক টেকসই হবে সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠতে পারে। আমার মনে হয় সরকারের উচিত দামের ব্যাপারে আরেকটু দরকষাকষি করা,” বলেন ম. তামিম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ চীনা কোম্পানিকে দেয়া দরপত্রের শর্তাবলী প্রকাশ করার দাবি জানান।
তিনি বেনারকে বলেন, “এই সরকার মনে করে জনগণ ও কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের জবাবদিহি নেই। কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছাড়াই তারা বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি কোম্পানির সাথে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প চুক্তি স্বাক্ষর করছে। কাজেই, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য সরকার প্রকাশ করবে না।”
“স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকার কারণে চুক্তিতে দেশ বিরোধী শর্তও থাকতে পারে,” মনে করেন আনু মুহাম্মদ।