গবেষণা প্রতিবেদন: বাংলাদেশে চীনা প্রভাব ভারতের সাথে এক ‘কার্যকর ভারসাম্য’

বেনারনিউজ স্টাফ
2019.12.13
ওয়াশিংটন ডিসি
191213-SEA-SA-studies_620.jpg চীনের রাজধানী বেইজিংএ ‘গোল্ডেন ব্রিজ অব সিল্ক রোড’ এর সামনে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ফোরামের লগো স্থাপনের কাজ করছেন কর্মীরা। ২৭ এপ্রিল ২০১৯।
[এপি]

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল চীন, জাতিসংঘে সদস্যপদ পেতেও বাধা দিয়েছিল দেশটি, সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বর্তমানে চীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের প্রধানতম উৎস।

এমনই মন্তব্য করেছে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যের উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এইডডাটা’।

“চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির পথে বাধা দিয়েছিল, দেশটির সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিতে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেরি করেছিল,” মন্তব্য করে এতে বলা হয়, “চীন-বাংলাদেশ তাদের প্রথম দিককার সেই অবস্থান থেকে এখন সরে এসেছে বহুদূর।”

এইডডাটা’র ‘সিল্ক রোড ডিপ্লোম্যাসি: ডিকনস্ট্রাক্টিং বেইজিংস টুলকিট টু ইনফ্লুয়েন্স সাউথ অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়া’ প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অধ্যায়ে বলা হয়, “বেইজিং এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের প্রধানতম উৎস।”

বাংলাদেশের ওপর ভারতের ‘দাদাগিরি’র কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষোভ রয়েছে মন্তব্য করে এতে বলা হয়, “অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর জন্য অর্থের উৎস ও নয়া দিল্লির সাথে কার্যকর ভারসাম্য” দুদিক থেকেই চীন বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হবার পর তাঁর প্রথম সরকারি বিদেশ সফর চীন ছিল উল্লেখ করে এতে বলা হয়, “দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০৯-২০১৫) শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের ওপর ভারত ও চীনের প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”

চীনকে বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী উভয় দলই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মনে করে বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) মহাপ্রকল্পের বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই ইতিবাচক।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “২০১৯ সালের মে মাসে, চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করা ‘বাংলাদেশ বিআরআই ফোরামে’ আওয়ামী লীগ ও বিনএপি উভয় দলই একমত হয় যে বেইজিং তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”

প্রসঙ্গত, এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোকে চীনের সাথে সরাসরি বাণিজ্যপথে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে মহাপ্রকল্প ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে চীন। এই প্রকল্পটি বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ হিসেবেও পরিচিত।

বাংলাদেশে চীনের অর্থ সহায়তার বেশিরভাগই অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে এসেছে জানিয়ে গবেষণায় বলা হয়, “চীনা অর্থায়নের ৯৯ ভাগই এসেছে ২০০০-২০১৭ সালের ভেতর, যার মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে এসেছে ১০.২ বিলিয়ন (এক হাজার বিশ কোটি) মার্কিন ডলার।”

অর্থায়নের শর্তে কড়াকড়ি না থাকা বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের কাছে চীনের অর্থ লোভনীয় হবার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

“বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের কাছে চীনা অর্থ বিভিন্ন কারণে আকর্ষণীয়: আর্থিক সুবিধা, কারিগরি দক্ষতা, এবং অন্যান্য দাতারা সুশাসন বিষয়ক যেসব কড়াকড়ি আরোপ করে থাকেন, সেসবের শিথীলতা।”

গত দুই দশকে চীনা কোম্পানিগুলোর অনেকেই নিজের দেশের তুলনায় সস্তা শ্রম সহজলভ্য হবার কারণে বাংলাদেশ তাদের কারখানা স্থাপন করেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “নৌ সিল্ক রোড ও বিনিয়োগের স্বার্থে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”

প্রসঙ্গত, নৌ সিল্ক রোড বা মেরিটাইম সিল্ক রোড চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের একটি অংশ।

“চীনা নেতারা প্রতিবেশি দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা এড়িয়ে চলতে চান,” উল্লেখ করে এতে বলা হয়, “বেইজিং তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও ভারতের সাথে ভারসাম্য রাখতে নিজেদের সামর্থ্য প্রদর্শন করতে আগ্রহী।”

তবে ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক থেকে চীন কোনোভাবেই উপকৃত হবে না বলে মনে করেন চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফয়েজ আহমেদ।

তিনি বেনারকে বলেন, “আসলে চীন ভারতকে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে চায়, কারণ ভারতের সমর্থন ছাড়া ওটি সফল হবে না। ভারতের সাথে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক থেকে চীন কোনোভাবেই উপকৃত হবে না।”

এদিকে চীনের বিশাল বিনিয়োগের পরও রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বাংলাদেশে চীন বিরোধী মনোভাব বাড়ছে বলে মনে করেন মুনশি ফয়েজ আহমেদ।

দূরত্ব তৈরি করছে সংস্কৃতি ও রোহিঙ্গা সংকট

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বিশাল বিনিয়োগের পরও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দিতে চীনের অনিচ্ছার কারণে বুদ্ধিজীবীরা চীনের ওপর অসন্তুষ্ট।

এ প্রসঙ্গে মুনশি ফয়েজ আহমেদ বলেন, “রোহিঙ্গা সংকটে চীন মিয়ানমারকে সমর্থন করার কারণে সাধারণ মানুষ চীনের ওপর বিরক্ত। সাধারণ মানুষের কথা হলো, চীন যদি বন্ধুই হবে, তবে তারা কেন আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারকে সমর্থন করবে?”

এদিকে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দূরত্বের কারণে বাংলাদেশিদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করা চীনের জন্য কঠিন বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

তবে নিজেদের প্রতি বাংলাদেশে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির জন্য চীন নিয়মিতভাবেই বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের জন্য শিক্ষা সফরের আয়োজন করে থাকে।

শিক্ষা সফরে বাংলাদেশিদের ‘সেরা আপ্যায়ন’ দ্বারা খুশি করা হয় যাতে তাঁরা ফিরে এসে চীনের মাহাত্ম বর্ণনার পাশাপাশি উইঘুর মুসলিম নির্যাতনসহ যেসব ক্ষেত্রে চীনের প্রতি বাংলাদেশে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তা বদলাতে সহায়তা করতে পারেন।

তবে পশ্চিমের দেশগুলোর তুলনায় সস্তা হবার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে চীনে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ব্যাপক হারে বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয় গবেষণায়।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের চীনে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তুলতে ২০০৬ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট খোলে চীন।

এর ফলে ২০০৬ সালে যেখানে বাংলাদেশ থেকে চীনে মাত্র ২০৯ জন শিক্ষার্থী গিয়েছিলেন, সেখানে ২০১৭ সালে তা ৩৫ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৩৪৩ জন।

২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চীন বাংলাদেশের ১,২০০ শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছে বলেও জানানো হয় গবেষণায়।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।