বিচারাধীন মামলা নিয়ে প্রতিবেদন না করার নির্দেশে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
2019.05.17
ঢাকা
বিচারাধীন মামলা নিয়ে প্রতিবেদন করা যাবে না- বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আদালতের এমন নির্দেশনা স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছে সাংবাদিক সংগঠনগুলো।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সাংবাদিকতা ও আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই।
বৃহস্পতিবার ওই বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করে উচ্চ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার গোলাম রাব্বানীর সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তাদের চ্যানেলে এবং কোনো কোনো প্রিন্ট মিডিয়া তাদের পত্রিকায় বিচারাধীন মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করে, যা একেবারেই অনভিপ্রেত।”
“এমতাবস্থায় বিচারাধীন কোনো বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হতে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো,” বলা হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের হয়ে নিয়মিত আদালত কাভার করেন প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মাসউদুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “যে চিঠিটি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার দিয়েছেন তা সংবিধানের ৩৯ ধারার সাথে সাংঘর্ষিক। তা ছাড়া দেশে ৩৫ লাখ মামলা বিচারাধীন, এর বাইরে আদালতে আর কোন নিউজই তো নেই।”
“বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় প্রত্যেক শুনানির দিন ধরে ধরে আমরা নিউজ করেছি। বর্তমান আইনমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ের আগে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে কথা বলেছেন, যা জানার জন্য সারাদেশ উদ্গ্রীব ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন ১/১১ এর সময় জেলে ছিলেন তখন শুনানির দিন ঘিরে নিউজ হতো,” বলছিলেন মাসউদুর রহমান।
তবে সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বেনারকে বলেন, “ভাষাগত দিক থেকে এই বিবৃতির উদ্দেশ্য হলো আদালতের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কোনো নিউজ করা যাবে না। এটাই মূল বিষয়। বিচারাধীন বিষয়ে নিউজ করা নিয়ে সমস্যা নয়।”
“মানুষের মনে আদালত সম্পর্কে আস্থা নষ্ট হতে পারে—এ ধরনের কোনো বিষয় স্ক্রল দিতে বা নিউজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। সাংবাদিকতার নিয়মও তো আছে। সেগুলো ফলো করে করলেই হবে,” বলেন তিনি।
সাইফুর রহমান বলছিলেন, গুটিকয়েক মিডিয়া আদালতের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে সংবাদ পরিবেশন করেছে বলেই এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো পত্রিকা বা গণমাধ্যমের নাম তিনি বলেননি।
সাইফুর রহমান বলেন, “কোনো নিউজ দ্বারা যদি সাধারণ মানুষের মনে আদালত সম্পর্কে প্রশ্নের উদ্রেক হয়, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, সে ক্ষেত্রে আদালতের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায়।”
উচ্চ আদালতের এমন বিজ্ঞপ্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকে। রিয়াদুল করিম নামে একজন সাংবাদিক লিখেছেন, “পুলিশ, ডাক্তার, সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, কৃষক, দিনমজুর যে কোরো বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ উঠলে লেখা যাবে। আপনাদেরটা লেখা যাবে না কেন?”
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ
উচ্চ আদালতের এমন বিজ্ঞপ্তির পর সঙ্গে সঙ্গে সেদিনই এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে আইন বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন- ল রিপোর্টাস ফোরাম (এলআরএফ)। বিজ্ঞপ্তিটি প্রত্যাহারের জন্য প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে তারা একটি লিখিত আবেদনও জানিয়েছেন।
ওই আবেদনে বলা হয়, “আইন, আদালত ও সংবিধান বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছে যে, বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগে একটি মামলার শুনানিকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে বিচারাধীন মামলায় প্রতিবেদন প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এ বিজ্ঞপ্তিতে আমরা সাংবাদিকেরা ব্যাথিত ও মর্মাহত।”
এলআরএফ জানায়, “দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আদালতে কর্মরত সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেল হত্যা মামলা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার শুনানিতে উপস্থিত থেকে প্রতিবেদন লিখে আসছেন। এর প্রেক্ষিতে দেশের মানুষ মামলার খুঁটিনাটি বিষয় জেনে আসছিল। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রেখে আসছে গণামাধ্যম।”
আবদেন বলা হয়, গত ৯ এপ্রিল মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এলআরএফ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতকালে তিনি বলেছিলেন, “আদালতে যা দেখবেন তাই লিখবেন।”
তাঁর এই বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়, “কিন্তু হাইকোর্টের বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রাব্বানীর স্বাক্ষরে যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে, তা মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী বলে মনে করে এলআরএফ।”
বিচারাধীন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সব সময় এলআরএফ নিয়ম–নীতিমালা অনুসরণ করে আদালত রিপোর্টিং করে আসছে উল্লেখ করে আদালতের বিজ্ঞপ্তিটি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানায়।
এদিকে বিচারাধীন কোন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন বা টিভিতে স্ক্রল দেওয়া থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের অনুরোধ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) নেতৃবৃন্দ।
শুক্রবার এক যৌথ বিবৃতিতে বিএফইউজে’র সভাপতি মোল্লা জালাল ও মহাসচিব শাবান মাহমুদ বলেন, “হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো: গোলাম রব্বানী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বিচারাধীন মামলার সংবাদ প্রকাশ না করার যে অনুরোধ জানানো হয়েছে তা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।”
বিবৃতিতে তারা বলেন, “একদিকে তথ্য অধিকার আইন পাস করা হয়েছে, অন্যদিকে সাংবাদিকদের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে যা রীতিমতো সাংঘর্ষিক। ''