ক্রিকেটারদের ধর্মঘটে ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে বিসিবি
2019.10.22
ঢাকা
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সকল জাতীয় ক্রিকেটারদের ডাকা ধর্মঘটকে ‘চক্রান্ত’ বলে অভিহিত করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। এমনকি তাদের ১১ দফা দাবি ‘এখন’ বাস্তবায়নের কোনো ব্যবস্থা নেবে না বলেও জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার এক জরুরি সভা শেষে বিসিবির সভাপতি নাজমুল হক পাপন এই ঘোষণা দেন।
নজিরবিহীন এই ধর্মঘটে অনিশ্চয়তায় পড়েছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের আসন্ন ভারত সফর।
এ বিষয়ে বিসিবি সভাপতি সাংবাদিকদের বলেন, “আসন্ন ভারত সফরকে কেন্দ্র করে যে ক্যাম্প শুরু হতে যাচ্ছে সেখানে ক্রিকেটাররা অংশ না নিলে তার কিছু করার নেই।”
তবে নভেম্বর ৩ তারিখে শুরু হতে যাওয়া বাংলাদেশ-ভারত সিরিজ আয়োজন করা না হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে জানান পাপন।
ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবির অনেকগুলোই পূরণ করা হয়েছে বা হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে দাবি করেন বোর্ড প্রধান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত একটি ম্যাচ দেখতে ভারত যেতে পারেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, আগামী মাসের তিন তারিখে বাংলাদেশ-ভারত সিরিজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এটা চলবে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত। বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খুব একটা খেলে না ভারত।
সোমবার সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সকল ক্রিকেটাররা ১১ দফা দাবি জানিয়ে এই ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। তাদের প্রাপ্য সম্মান না দেয়া হলে, বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা না হলে কোনো ধরনের ক্রিকেট খেলবেন না বলে জানান তাঁরা।
তবে ক্রিকেটের এই অচলাবস্থাকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না দেশের সাধারণ মানুষ এবং সাবেক ক্রিকেটাররা। তবে তারা বলছেন, ১১ দফা যৌক্তিক। তারা চান যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যা দূর হোক। খেলোয়াড়রা মাঠে ফিরে যাক।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য তারেক আজিজ বেনারকে বলেন, “ক্রিকেটারদের দাবিগুলো যৌক্তিক। ১১ দফার কোনটি ফেলে দেয়ার নয়। বর্তমানে ক্রিকেটাররা তাদের ইচ্ছেমতো দলে খেলার অধিকার রাখেন না।”
তিনি বলেন, “আজকে যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব আছেন তাদের অনেকেই দু-এক বছরের মধ্যে খেলা ছেড়ে দেবেন। তবে ভবিষ্যতের জন্য এই কথাগুলো বলার দরকার ছিলো।”
তারেক আজিজ বলেন, “ক্রিকেটাররা সবাই পেশাদার। তাদের কথাগুলো আমলে নিতে হবে। তার পরিবর্তে যদি তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখে বিসিবি তবে সেটি ভালো ফল বয়ে আনবে না।”
তিনি বলেন, “তাই বিসিবির উচিত, যত দ্রুত সম্ভব, খেলোয়াড়দের সাথে আলোচনায় বসে সমস্যার সুরাহা করা। খেলোয়াড়রা মাঠে ফিরে যাক। ভারত সফরের দিকে নজর দিক।”
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের ছাত্র ঐশিক জাওয়াদ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য এই স্ট্রাইক দরকার ছিলো। তাদের প্রায় দাবিগুলো যৌক্তিক। এই আন্দোলন ভবিষ্যৎ ক্রিকেটারদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।”
ধর্মঘট ডাকা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের প্রতি সমর্থন দিয়েছে ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ফিকা। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সংগঠন কোয়াবের প্রতি কিছুটা বিরক্তিও প্রকাশ করেছে তারা।
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র
মঙ্গলবার বিসিবি সভাপতি পাপন সাংবাদিকদের বলেন, “ক্রিকেটারদের দাবিগুলো বর্তমান অবস্থায় মানা সম্ভব নয়।… দাবিগুলো আমাদের কাছে চাইলেই পেতেন। আমাদের কাছে না চেয়ে মিডিয়ার সামনে বলার দরকার কি?”
তিনি বলেন, “খেলোয়াড়রা আমাদের না জানিয়ে বিষয়গুলো সাংবাদিকদের জানিয়েছে, এতে আমি বিস্মিত। সব মিলিয়ে আমি ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি।”
পাপন বলেন, “দাবি ওরা জানাতেই পারে। খুবই ন্যাচারাল। কিন্তু সেটির জন্য তারা স্ট্রাইকে গেছে, এটা এক্সট্রিমলি শকিং। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমাদের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে এমন কিছু হতে পারে।”
এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ডিস্ট্যাবিলাইজ (অস্থিতিশীল) করার ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে করেন তিনি।
বিসিবি সভাপতি বলেন, “দুই-একজন খেলোয়াড় এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে। বাকি ক্রিকেটাররা না বুঝে আন্দোলনে গেছে।”
তিনি বলেন, “ওরা এখন চায় ভারত সফরে যদি না যায় তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। এটা ষড়যন্ত্রের অংশ। কিছুদিনের জন্য সময় চাচ্ছি। সবকিছু প্রকাশ করা হবে।”
পাপন বলেন, “বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই জানে না আসল পরিকল্পনাটা কি। ওরা না জেনেই এসেছে। আসল পরিকল্পনা জানে দু-একজন।”
যা চান ক্রিকেটাররা
সোমবার সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে উত্থাপন করা ১১ দফা দাবি মূলত ক্রিকেটারদের স্বাধীনভাবে বিভিন্ন ক্লাবে খেলার অধিকার, আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি, বৈষম্য দূরীকরণ ও বিসিবির কাছ থেকে ‘সম্মানজনক ব্যবহার’ পাওয়াকে কেন্দ্র করে।
বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের আর্থিক উৎস তিনটি। তার অন্যতম হলো ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাত বছর আগে পাপন বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে খেলোয়াড়রা তাদের ইচ্ছেমতো ক্লাবের সাথে দর-কষাকষি করে খেলতে পারতেন। খেলোয়াড়দের মান অনুসারে এক মৌসুমে খেলোয়াড়দের সর্বনিম্ন আয় ছিল পাঁচ লাখ টাকা। আর সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা।
আবাহনী ক্লাবের অন্যতম পরিচালক পাপন সভাপতি হওয়ার পর সেই পদ্ধতির পরিবর্তে ক্লাবগুলোকে খেলোয়াড় পছন্দ করার ক্ষমতা দেয়া হয়। আর সর্বনিম্ন আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়। সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারিত হয় ৩৫ লাখ টাকায়।
আবার ২০১২ সালে শুরু হওয়া বিপিএল খেলোয়াড়দের জন্য একটি বড় আয়ের উৎস। তবে সেখানে রয়েছে মজুরি বৈষম্য। এ-প্লাস মানের একজন বিদেশি খেলোয়াড়কে দেয়া হয় দুই লাখ ডলার। পক্ষান্তরে একই মানের দেশি খেলোয়াড়কে দেয়া হয় ৪৭ হাজার ডলার থেকে ৮৫ হাজার ডলার।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামাল বিসিবি সভাপতি থাকাকালে ১০৫ জন জাতীয় ক্রিকেটারদের তিন ধাপে ভাগ করে মাসিক বেতনের ব্যবস্থা করেন। সর্বোচ্চ বেতন দেয়া হয় ২৫ হাজার টাকা; সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা।
পাপন সভাপতি হওয়ার পর সেই বেতনপ্রাপ্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা নামিয়ে আনা হয় ৭০ জনে। তবে বেতন রয়ে যায় একই।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেন, এই মাসিক বেতন এক লাখ টাকা হওয়া উচিত।
বর্তমানে ক্রিকেট বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা বলে মনে করা হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশ নিয়মিত ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে। ২০১১ সালে ভারতের সাথে যৌথভাবে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজন করে বাংলাদেশ।