চলে গেলেন ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ পলান সরকার
2019.03.01
ঢাকা

নিজের টাকায় বই কিনে পায়ে হেঁটে তা ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি দিয়ে আসতেন পলান সরকার, নির্দিষ্ট সময়ের পর নিয়েও আসতেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা এই ব্যক্তির পরিচিতি হয়ে ওঠে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। শতবর্ষ ছুঁতে দুই বছর বাকি থাকা এই অসামান্য মানুষটি শুক্রবার চলে গেলেন।
তাঁর ছেলে হায়দার আলী সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার দুপুরে রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে তাঁর নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পলান সরকার। তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন।
পলান সরকারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর এলাকার সংসদ-সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
প্রবীণ এই নাগরিকের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাঁর অবদানের কথা ঘুরেফিরে আসছে নানাভাবে।
প্রকৃত নাম হারেজ উদ্দিন হলেও পলান সরকার নামে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। ১৯২১ সালে নাটোরে জন্ম নেওয়া পলান সরকার বসবাস করতেন রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলায়। শৈশবে পিতা মারা গেলে তিনি একই এলাকায় তাঁর নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন।
দারিদ্রের কষাঘাতে লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। যৌবনে ইউনিয়ন পরিষদের কর আদায়কারী হিসাবে কাজ করতেন। পারিবারিক সূত্রে পেয়েছিলেন কিছু জমিজমা।
লেখাপড়া না করতে পারলেও এই ব্যক্তির বইয়ের প্রতি ছিল অদম্য ভালোবাসা ও আকর্ষণ।
দেশের ভবিষ্যত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে ১৯৯০ সালের পর তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার। গ্রামের যেসব ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে প্রথম থেকে দশম স্থান অধিকার করত, তাদের বাড়ি গিয়ে বই ধার দিয়ে আসতেন তিনি। পড়া শেষ হলে নিজেই আবার ফেরত নিয়ে আসতেন। আর এভাবেই তিনি পার করেন জীবনের একটি বড় সময়।
যৌবনে যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে সংলাপ পড়তে গিয়ে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় তার। ১৯৬৫ সালে তাঁর নিজ গ্রাম বাউসায় হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য নিজের জমি দান করেন। তাঁকে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত করে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
পলান সরকারের এই অবদানের কথা আশেপাশের কিছু এলাকায় জানলেও ২০০৬ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে তাঁর সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রচার হয়। সারাদেশ তাঁর নাম জানতে পারে।
২০০৭ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় তাঁর ওপর বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ উপাধিতে পরিচিত হন সারাদেশে।
পরে সরকারিভাবে পলান সরকারের বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বিশ্বের ভিন্ন ভাষার প্রধান প্রধান দৈনিকে একযোগে পলান সরকারের বই পড়ার এই আন্দোলনের গল্প ছাপা হয়।
তাঁকে নিয়ে ‘সায়াহ্নে সূর্যোদয়’ নামে একটি নাটক তৈরি হয়েছে। ২০১১ সালে সামাজিক অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত হন পলান সরকার।
সরকারের আর্থিক সহয়তায় তাঁর নামে একটি পাঠাগার স্থাপিত হয়েছে বাঘায়।
তিনি বলেন, “এখন সারাদেশ তার নাম জানে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. মজনু বেনারকে বলেন, “তিনি আমাদের এলাকায় বই বিতরণ করতেন। আমি নিজেও তাঁর কাছ থেকে বই ধার নিয়ে পড়েছি।”
মজনু আরো বলেন, “পলান সরকার বাঘা এলাকার শত শত ছেলেমেয়ের হাতে বই তুলে দিয়েছেন। তারা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই সব ছাত্র-ছাত্রী অন্যান্য ছেলেমেয়েদের চেয়ে আলাদা হবে। তারা আলোকিত সমাজ গড়তে অবদান রাখবে।”
বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতির নেতা ও কলাম লেখক ওহিদুজ্জামান লিটন বেনারকে বলেন, “পলান সরকারকে বলা হতো ‘চলন্ত গ্রন্থাগার’। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে তিনি অবদান রেখে গেছেন।”
লিটন বলেন, “পলান সরকার মানুষের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে ছোট ছেলেমেয়েদের বেছে নিয়েছিলেন। কারণ তারা দেশের ভবিষ্যত। শিক্ষার্থীদের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ এবং পাঠাগারে যাওয়ার অভ্যাস তৈরিতে তিনি অনেক অবদান রেখেছেন।”
তাঁর মতে, “ডিজিটাল যুগে সবাই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝুঁকে পড়েছে। ছেলেমেয়েদের পড়ার অভ্যাস তৈরি করা তাই ভীষণ জরুরি। আমি মনে করি, পলান সরকারকে দেখে অনেকেই উৎসাহিত হয়ে পাঠাগার ও পাঠাভ্যাস তৈরিতে নিজেদের উৎসর্গ করবেন। থেমে যাবে না তাঁর আলোকিত সমাজ গড়ার আন্দোলন।”
পলান সরকারের দেখানো পথে হেঁটেছেন বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার রেজাউল করিম রেজা।
তাঁর একমাত্র সন্তান সাকিব মারা গেলে তিনি নিজের দোকানকে গড়ে তোলেন পাঠাগার হিসেবে। ছেলের নাম অনুসারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপন করেন সাকিব স্মৃতি পাঠাগার।
রেজা বেনারকে বলেন, “পলান সরকারকে দেখে আমি উদ্বুদ্ধ হয়ে আমার ছেলের নামে এই পাঠাগার স্থাপন করেছি। এখানে প্রতিদিন অনেক পাঠক পড়তে আসেন। সমাজ পরিবর্তনে পড়ার কোনো বিকল্প নেই।”
পলান সরকারের মেয়ে রোকেয়া খাতুন বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “আমার বাবা খুব সাধারণ মানুষ। তাঁর নামের আগে কোনো ডিগ্রি নেই। পদবি নেই। আজ এই বাবাকে নিয়েই আমি গর্বিত।”
২০১৭ সালের ১৭ জুন প্রথম আলোয় ‘আমার বাবা পলান সরকার’ শিরোনামে ওই লেখায় রোকেয়া আরও বলেন, “আমি মনে করি, আমার বাবার নামটাই এখন একটা বিশেষণ হয়ে গেছে। রাজশাহীতে এক যুবক তাঁর একটি ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের নাম রেখেছে ‘পলান সরকার পাঠাগার’। ভাবলেই ভালো লাগে।” তাঁর লেখার শেষ বাক্য ছিল, “আমার বাবা আমার অহংকার।”