১১ নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা
2020.05.06
ঢাকা

করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় সরকারের নানা ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১ নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে গ্রেফতার করা কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর (৪৫) ও লেখক মুশতাক আহমেদকে (৫৩) মঙ্গলবার গ্রেফতার করে বুধবার কারাগারে পাঠানো হয়।
পুলিশ জানায়, আহমেদ কবির কিশোরকে কাকরাইল ও মুশতাক আহমেদকে লালমাটিয়ার বাসা থেকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়, ওই দিন রাতে তাঁদের রমনা থানায় সোপর্দ করে র্যাব। বুধবার তাঁদের আদালতে হাজির করা হয়, জামিনের আবেদন বাতিল করে তাঁদের কারাগারে পাঠান ঢাকা মহানগর হাকিম।
রাজধানীর রমনা থানায় মঙ্গলবার রাতে র্যাবের তিন নম্বর ব্যাটেলিয়নের ডিএডি (ওয়ারেন্ট অফিসার) মো. আবু বকর সিদ্দিক মামলাটি দায়ের করেন। এতে ওই দুজনসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ফেসবুকে সরকার বিরোধী প্রচারণার অভিযোগ এনেছে র্যাব। মামলায় আরও পাঁচ থেকে ছয়জন অজ্ঞাত পরিচয়ের আসামি রয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ আছে।
এদিকে নিখোঁজ দিদারুল এবং আরেক আসামী মিনহাজকে বুধবার গ্রেপ্তার দেখিয়ে সন্ধ্যায় রমনা থানায় সোপর্দ করেছে র্যাব, বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “কালই (বৃহস্পতিবার) তাদের আদালতে নেওয়া হবে।” উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাস এলাকার নিজ বাড়িতে জঙ্গি হামলায় নিহত ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কর্মকর্তা ও যৌন সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার আদায়ে সোচ্চার এ্যাক্টিভিস্ট জুলহাজ মান্নানের বড় ভাই মিনহাজ।
রাষ্ট্রচিন্তার সংবাদ সম্মেলন
দিদারুলের সংগঠন রাষ্ট্রচিন্তা বুধবার সকালে ফেসবুকে অনলাইন সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়। এ সময় তাঁর স্ত্রী দিলশানারা অপর্ণা জানান, মঙ্গলবার ইফতারির কিছুক্ষণ আগে দুটি মাইক্রোবাসে করে ১১-১২ জন এসে র্যাব পরিচয়ে তাদের বাসায় প্রবেশ করে। তারা কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাঁকে (দিদারুল) এবং তারঁ দুটি সিপিইউ, ল্যাপটপসহ সিসি ক্যামেরার সরঞ্জাম নিয়ে যায়।
“আমাদের শুধু বলে যায়, কিছু কথাবার্তা বলেই আমরা ওনাকে ছেড়ে দেব,” জানান অপর্ণা।
সাদা পোশাকে কাউকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া বন্ধ করতে উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো মানছে না বলে অভিযোগ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। দিদারুলকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত দেওয়ার দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলন থেকে।
“দিদার একজন দেশপ্রেমিক। ফেসবুকে সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা যেমন করতেন, একইভাবে ভালো কাজের প্রশংসাও করতেন। তাঁর সাথে এমন আচরণ মোটও কাম্য নয়,” বেনারকে বলেন রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম।
মামলার অন্য আসামি যাঁরা
মামলার আসামিদের মধ্যে আরো আছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও বিএলআই সিকিউরিটিজের কর্ণধার মিনহাজ মান্নান ইমন, প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও সাহেদ আলম, সায়ের জুলকার নাইন, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার, স্বপন ওয়াহিদ এবং ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার উপ-পরিদর্শক জামশেদুল ইসলাম বুধবার দুপুরে কিশোর ও মুশতাককে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন।
বেনারকে জামশেদুল বলেন, “আপাতত কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হলেও তাদের রিমাণ্ড চাওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। রিমান্ড প্রতিবেদন প্রস্তুত করার পর সেই আবেদন করা হবে। একই সঙ্গে অন্য আসামীদের গ্রেপ্তার করা চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে র্যাবও সহায়তা করবে।”
“মামলার যেসব আসামি বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের আপাতত আমরা গ্রেপ্তার করতে পারব না। তবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে পলাতক দেখিয়ে আদালতে চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। এতে তাঁদের নামে পরোয়ানা জারি হয়ে থাকবে। ১০ বছর পর দেশে আসলেও গ্রেফতার করার সুযোগ থাকবে,” বলেন তিনি।
যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে
মামলার এজাহারে র্যাবের কর্মকর্তা জানান, অভিযুক্তরা ‘আই অ্যাম বাংলাদেশি’ (ইংরেজিতে লেখা) নামের একটি ফেসবুক পেজসহ তাদের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজবসহ রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিপ্রায়ে অপপ্রচার চালিয়েছেন।
তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, “জিজ্ঞাসাবাদে কিশোর জানান, সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়, করোনাভাইরাস, জাতির জনক, সরকার প্রধান, সরকার দলীয় বিভিন্ন নেতাদের কার্টুনের ব্যঙ্গচিত্র দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার ব্যাপারে প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল তাঁকে ইন্ধন দিয়েছেন।”
এ ব্যাপারে সুইডেনে অবস্থানরত সাংবাদিক ও নেত্র নিউজের এডিটর-ইন-চিফ তাসনিম খলিল বেনারকে বলেন, “কার্টুনিস্ট কিশোর আমার ফেসবুক বন্ধু। তিনি মাঝে মাঝে তাঁর আঁকা কার্টুন আমাকে মেসেঞ্জারে পাঠাতেন। কিছু দিন আগে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁকে কে বা কারা ফলো করছে এবং তিনি নিজের নিরাপত্তার নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমি বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি আর কোনো উত্তর দেননি।”
“তাঁকে আমি ঠিক কীভাবে ইন্ধন দিয়েছি, সেটা এজাহারে স্পষ্ট করে বলা হয়নি,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে করোনা মহামারি মোকাবেলায় বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা একজন পলিটিক্যাল কার্টুনিস্টের কার্টুন আঁকার রসদ হিসেবে যথেষ্ট। এখানে অন্য কারো ইন্ধনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।”
কিশোরের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই দেশে বাণিজ্যিক কুমির চাষের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত মুশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তারের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। মুশতাকের স্ত্রী মাছিহা আক্তার লিপা বেনারকে বলেন, “এর আগে আলোকচিত্রী শহীদুল আলমকে গ্রেপ্তারের পর অনলাইনে প্রতিবাদ করায় তাঁকে একইভাবে তুলে নিয়ে গিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ, আর এবার নিয়েছে র্যাব ।”
“তখন মামলা হয়নি। এমন কিছু আর করবে না মর্মে মুচলেকা দিয়ে তখন ছাড়িয়ে আনতে হয়েছিল তাঁকে,” উল্লেখ করেন লিপা।
তিনি আরও বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন পাওয়া যাবে না, উচ্চ আদালত বা সাইবার ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে । কিন্তু ওই দুটো আদালত এখন বন্ধ।”
এদিকে ‘আমি কিশোর’ ও ‘মাইকেল কুমির ঠাকুর’ নামে ফেসবুক আইডি থেকে কিশোর ও মুশতাক অপপ্রচার চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে র্যাব।
মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, যারা একটু খোলামেলা আলোচনা করতে চায়, নিজের স্বাধীন মত তুলে ধরতে চায়, এই ধরনের মামলা দিয়ে মূলত তাদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।
“সোশ্যাল মিডিয়া এ্যাক্টিভিস্ট বা সাংবাদিকদের কেউ যাতে সরকারের ব্যর্থতা বা অব্যবস্থাপনা নিয়ে আর কথা বলতে না পারে, সে জন্য ক্ষমতাসীনেরা এমন মামলা দিচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, সরকারের সমালোচনা, গুজব ছড়ানোসহ নানা অভিযোগে গত শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচজন সাংবাদিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা সবাই জেলে আছেন।
৩১৩ নাগরিকের উদ্বেগ
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ৩১৩ নাগরিক বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা দিদারুলের সন্ধান, গ্রেপ্তার করা কিশোর ও মুশতাকের মুক্তিসহ মামলা প্রত্যাহার এবং এ পর্যন্ত মত প্রকাশের জন্য গ্রেপ্তার করা সব নাগরিকের মুক্তি চেয়েছেন।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক নেতা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কবি-লেখক-সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, আলোকচিত্রী, শিল্পী, সংগঠক ও গবেষক।
এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এসব সংগঠনের মধ্যে আছে বাম গণতান্ত্রিক জোট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় কমিটি।