চাঁদ দেখার বিভ্রান্তিতে ঈদ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক
2019.06.05
ঢাকা
শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে বিভ্রান্তি অবশেষে রাজনৈতিক বিতর্কে পর্যবসিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়।
“এ নিয়ে সমালোচনা বা বিতর্কের কিছু নেই। চাঁদ দেখা কমিটি শরিয়ত মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেই অনুযায়ী ঈদ উদযাপিত হচ্ছে,” বেনারকে বলেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ।
তবে ঈদ উযাপন নিয়ে এমন বিভ্রান্তির জন্য জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির অবহেলাকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বৈজ্ঞানিক পন্থা অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
অন্যদিকে দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির দাবি, চাঁদ দেখা নিয়ে এই বিভ্রান্তির কারণ সুশাসনের অভাব।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “দেশে সুশাসন না থাকলে যা হয়, তাই হয়েছে। ওনারা মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে বললেন চাঁদ দেখা যায়নি। ঈদের তারিখও বলে দিলেন বৃহস্পতিবার। আবার তিন ঘণ্টার ব্যবধানে সে সিদ্ধান্ত পাল্টালেন।”
ঈদের দিন সকালে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানানোর পর এ কথা বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার রাতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বায়তুল মোকাররম সভাকক্ষে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির বৈঠকের পর জানানো হয়েছিল দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি। তাই বুধবার নয় বৃহস্পতিবার ঈদ উদযাপন করা হবে।
এর প্রায় তিন ঘণ্টা পর রাত সোয়া ১১টায় চাঁদ দেখা কমিটির পক্ষ থেকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী নতুন করে ঘোষণা দেন, “শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেছে। বুধবারই ঈদ হবে।”
ততক্ষণে সরকারের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী দেশের অধিকাংশ মানুষ তারাবীহের নামাজ পড়ে এবং বুধবার রোজা রাখার প্রস্তুতি নেয়। তবে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই দেশজুড়ে বুধবার মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ পালিত হয়েছে।
দেশের প্রায় সকল জায়গায় দিনভর বৃষ্টি ঈদ আয়োজনে বিঘ্ন ঘটালেও ঈদ আনন্দে ভাটা পড়েনি।
যে কারণে বিভ্রান্তি
বিভ্রান্তির ব্যাখ্যায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ বলেছেন, “রাত নয়টা পর্যন্ত আমরা বৈঠকে ছিলাম। সকল জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু তখন পর্যন্ত দেশের কোথাও চাঁদ দেখা গেছে এরকম খবর পাওয়া যায়নি। এ কারণেই বৃহস্পতিবার ঈদ উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।”
তিনি জানান, মঙ্গলবার রাত ১০টার পর কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা এবং লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শতাধিক ব্যক্তি চাঁদ দেখেছেন বলে খবর আসে। সেটা সঠিক কিনা তা যাচাইয়ের জন্য কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এরপর চাঁদ দেখা কমিটির সদস্যরা আবার বৈঠক করে সিদ্ধান্ত বদল করে।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেন, “পবিত্র কোরআন হাদিসের আলোকে চাঁদ দেখার সংশোধিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদি কমপক্ষে দুজন পুরুষ চাঁদ দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দেন, তাহলে শরিয়ত মোতাবেক সেটা মানতে হয়।”
“আমরা সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে কারও ব্যক্তিগত লাভ নেই। সুতরাং এই নিয়ে বিতর্ক করা এবং রাজনীতি করা ভুল,” বলেন তিনি।
বিতর্কের পুনরাবৃত্তি
চাঁদ দেখা নিয়ে বিভ্রান্তি এবারই প্রথম নয়। এ বছর শব-ই-বরাতের চাঁদ দেখা নিয়ে বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। মজলিসে রুইয়াতুল হিলাল নামের একটি সংগঠন বেসরকারিভাবে চাঁদ পর্যবেক্ষণের কাজে সম্পৃক্ত আছে। সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবীরা বাংলাদেশের সকল জেলায় ও উপজেলায় এবং পৃথিবীর বিভিন্নস্থানে জ্যোতির্বিদ্যার নিয়ম ও সময় অনুসারে চাঁদ দেখা এবং ঘোষণা দেওয়ার জন্য তৎপর রয়েছে।
মজলিসে রুইয়াতুল হিলালের সভাপতি এ বি এম রুহুল হাসান বেনারকে বলেন, “অ্যাস্ট্রলোজি অনুযায়ী যদি আকাশ মেঘলা না থাকে তাহলে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার সম্ভাবনা ছিল শতভাগ। কিন্তু আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী উত্তরবঙ্গ ছাড়া সারা দেশ মেঘলা থাকার সম্ভাবনা ছিল। এ কারণে আমরা আমাদের উত্তরবঙ্গের স্বেচ্ছাসেবীদের অ্যালার্ট রেখেছিলাম।”
“কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও এবং সুনামগঞ্জ থেকে আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা সন্ধ্যার পরই চাঁদ দেখার পর আমাদের জানিয়ে দেয়। তারা এলাকার প্রশাসনকেও বিষয়টি অবহিত করে। সুতরাং ৯টার আগে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি বার্তা পায়নি এটা সত্য নয়,” বলেন রুহুল হাসান।
মজলিসে রুইয়াতুল হিলাল এ বছর ২১ এপ্রিলের পরিবর্তে ২০ এপ্রিল শব-ই-বরাত পালনের দাবিতে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছিল। কিন্তু ধর্মীয় আবেগঘন বিষয় আদালত পর্যন্ত নেওয়া উচিত নয় মন্তব্য করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তাদের মামলা ফিরিয়ে দিয়েছিল।
বৈজ্ঞানিক পন্থা অনুসরণের পরামর্শ
সৌদি আরবে যে দিন ঈদ পালিত হয়, বাংলাদেশের কোনও কোনও অঞ্চলের অল্পকিছু মানুষ সেদিনই ঈদ পালন করেন। তবে দেশের প্রায় সকল মুসলমান জাতীয় ঘোষণা অনুযায়ী, একসঙ্গে উৎসব পালন করেন। এ নিয়ে বারবার বিভ্রান্তি হওয়ায় কেউ কেউ বলছেন, বৈজ্ঞানিক পন্থা অনুসরণ করে দিন নির্ধারণ করা দরকার।
ইসলামী চিন্তাবিদ ড. এম শমসের আলী বেনারকে বলেছেন, “ইসলামিক বিধান অনুযায়ী দুই জন ব্যক্তি চাঁদ দেখলেই সেটা অনুসরণ করা সবার দায়িত্ব হয়ে যায়। পৃথিবীর যেকোনও স্থানে দুই বা দুইয়ের অধিক ব্যক্তি চাঁদ দেখলে সে অনুযায়ী পৃথিবীর সকল মুসলমান ঈদ পালন করতে পারে।”
তিনি বলেন, “অতীতে পৃথিবীর কে কোথায় চাঁদ দেখেছে তা সবার জানার সুযোগ ছিল না। এখন বিজ্ঞানের কল্যাণে পৃথিবীর সকল মানুষ সেকেন্ডের মধ্যে চাঁদ দেখার খবর পেয়ে যান। সে অনুযায়ী ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসব পালন করা ইসলাম সম্মত।”