একদল নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ
2024.01.08
ঢাকা

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীদের মতে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে বাংলাদেশ ক্রমেই ‘একটি দল নিয়ন্ত্রিত’ রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আরও সঙ্কুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় রোববার অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছে।
অর্থনৈতিক সমস্যা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে । এই পরিস্থিতেকে নিয়ন্ত্রণ করাই হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
সোমবার নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন দেশের জন্য যুগান্তকারী ঘটনা উল্লেখ করে বলেছেন, “এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত পারে।”
একই দিন বিকেলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ২৯৮টি ঘোষিত ফলাফলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী এককভাবে ২২২টি আসন, জাতীয় পার্টি ১১ আসন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২ এবং জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পেয়েছে।
আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করবেন বলেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সোমবার সাংবাদিকদের জানান।
যা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’।
তিনি বলেন, “এই নির্বাচনে যেসব দল অংশগ্রহণ করেছে এবং যেসব দল নির্বাচন বয়কট করেছে; দুই দলের জন্যই এই নির্বাচন টার্নিং পয়েন্ট।
“এই নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে বলা যায়, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্যান্য ছোট ছোট দলগুলো ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। নতুন দলের আবির্ভাব হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছে। আমার মনে হয়, তারা নির্বাচন বয়কট করে ভুল করেছে। যা হবে সেটি হলো বিএনপি আগামী পাঁচ বছর চেয়ে চেয়ে দেখবে। ভবিষ্যতে বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করতে চাইবে আওয়ামী লীগ। জাতির জনকের বিরোধিতা করে, অসম্মান করে কেউ রাজনীতি করবে, সেটি আওয়ামী লীগ মানবে না।”
অধ্যাপক মিজান বলেন, “এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো কোনো অবরোধ দেবে বলে আমি মনে করি না। যদি কোনো অবরোধ আসে, সেটি হবে মার্কিন সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শক্তি ও দুর্বলতা - দুই-ই প্রকাশ পেয়েছে।
তিনি বলেন, “২০১৮ সালে বিএনপির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শতকরা প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবার বিএনপির বয়কটের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে শতকরা ৪০ শতাংশের কিছু বেশি। এই দুই পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বলা যায়, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমেছে। কারণ এই নির্বাচন ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের।”
তিনি বলেন, “অন্যদিকে বিএনপির সফলতা হলো, দেশের শতকরা প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের ডাকে সাড়া দেয়নি, ভোট দিতে যায়নি, যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়।”
অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন বলেন, “ভোটের মানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থানের সঙ্গে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে; যদিও ভোটারের সংখ্যা কম ছিল। তাই বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি-এই যুক্তিতে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ কিছুটা হলেও কমেছে।
এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক কোনো সমস্যার মুখোমুখি হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে শ্রমিকের অধিকার অথবা অন্য কোনো বিষয়ে অবরোধ আসলেও আসতে পারে। তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো থেকে কোনো অবরোধ আসবে বলে আমি মনে করি না।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন, দেশে একটি বহুদলীয় কার্যকর গণতন্ত্র চালু থাকা। সেই আশায় গুঁড়ে বালি। এই নির্বাচনের ফলে দেশে যে ব্যবস্থা থাকবে, সেটিকে আমরা বইয়ের ভাষায় বলি ‘ওয়ান ডমিনেন্ট পার্টি সিস্টেম’। অর্থাৎ একটি দল থাকবে, যে দল দেশের বিরোধী দল থেকে শুরু করে সংসদ ও সংসদের বাইরে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ নিজে কোনো ইস্যু সৃষ্টি না করলে সামনের দিনগুলোতে বিএনপির জন্য আন্দোলনের কোনো ইস্যু থাকবে না।”
আগামী দিনগুলোতে ভিন্ন মতের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আরও অসহিষ্ণু হবে, সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে দেশে অনেক কিছু আমদানি বন্ধ রয়েছে। এভাবে আমদানি বন্ধ রেখে কতদিন চলবে? এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জন্য একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক খাতে ব্যর্থ হলে তাদের রাজনৈতিক মূল্য দিতে হবে।”
সুষ্ঠু নির্বাচনের উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে: শেখ হাসিনা
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসস জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়কে জনগণের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, বাংলাদেশ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে। নির্বাচনকে খুব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার সব ধরণের ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি, যেটা আপনারা (পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক) নিজেরাই দেখেছেন।”
“এ বিজয় আমার বিজয় নয়, এটি জনগণের বিজয়,” বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার বিকেলে গণভবনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আগত বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানের শুরুতে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে, আমাদের অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচিত হয়েছে এবং অন্য দলগুলো থেকেও নির্বাচিত হয়েছে, দেশের মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এবারের নির্বাচন ছিল ব্যতিক্রমী। এবার আমি প্রার্থী দেওয়ার পাশাপাশি সবার জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিই।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি যে, এটা আমাদের দেশের জন্য এবং গণতন্ত্রের জন্য একটি অত্যন্ত যুগান্তকারি ঘটনা। কারণ, আমি অনেকবারই নির্বাচন করেছি। তবে, মানুষের এত আগ্রহ আগে আর কখনো দেখিনি। সেজন্য আমি মনে করি, বাংলাদেশের জনগণও খুব আনন্দিত যে আপনারা এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং নির্বাচন সম্পর্কে নানা মতামত দিয়েছেন। ”
নির্বাচনকে ''একতরফা প্রহসনের ভোট '' আখ্যা দিয়ে কালো কাপড় বেঁধে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণঅধিকার পরিষদের অবস্থান কর্মসূচি। ০৮ জানুয়ারি ২০২৪। [জীবন আহমেদ /বেনারনিউজ]
ডামি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে দেশবাসী: তারেক রহমান
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সোমবার ভিডিও বার্তায় বলেছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে ও সাহসিকতার সঙ্গে ডামি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেজন্য তিনি দেশবাসীকে অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, প্রহসনমূলক তথা সহিংস এই নির্বাচনে অংশ না নিয়েও সর্বজনীন বর্জনের মাধ্যমে আজ জাতির অর্থবহ বিজয় অর্জিত হয়েছে; যার গৌরব দেশের প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের।
নির্বাচনের নামে দেশজুড়ে যা ঘটেছে, আদৌ তা কোনো নির্বাচন নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার ওপর ফ্যাসিবাদের ন্যাক্কারজনক আঘাত বলে মনে কনে তিনি।
তারেক বলেন, বিএনপিসহ ৬৩টি গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করা সত্ত্বেও দেশের প্রতিটি আসন ও কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ যেভাবে সংঘবদ্ধভাবে কারচুপি, অনিয়ম, সহিংসতা ও সংঘাত সৃষ্টি করেছে, একের পর এক যেসব ছবি, ভিডিও ও তথ্য আমরা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি, তাতে এটিই আবার প্রমাণিত হয় যে, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব নয়।