দেশ গড়তে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন প্রধানমন্ত্রী
2019.01.25
ঢাকা

একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে চতুর্থবারের মতো সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশ গড়তে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংখ্যায় কম হলেও বিএনপির নির্বাচিতদের শপথ নিয়ে সংসদে আসার আহ্বান জানিয়ে তাঁদের প্রস্তাব ও সমালোচনার যথাযথ মূল্যায়নের প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির সামনে এটাই তাঁর প্রথম ভাষণ। এসময় তিনি গত ১০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরেন।
ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, “এখন আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের ঐক্যের যোগসূত্র হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও ন্যায়বিচার এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি।”
“সরকারের দৃষ্টিতে দলমত-নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিক সমান। আমরা সবার জন্য কাজ করব,” বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যকে ‘প্রতারণামূলক’ অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও প্রধানমন্ত্রীর ঐক্যের ডাককে নিছক ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ হিসেবেই দেখছেন।
“প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলো বলেছেন তা রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়,” বলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী।
তিনি বেনারকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঐক্যের ডাক দিয়েছেন কিন্তু যে নির্বাচন তিনি করেছেন তার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। এটা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন।”
“তবে যদি সত্যি এটা (জাতীয় ঐক্য) বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে নতুন নির্বাচন দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করুন। জাতীয় ঐক্য করতে হলে প্রকৃতপক্ষে যারা জনগণের প্রতিনিধি তাঁদের নিয়ে তা করতে হবে,” বলেন দিলারা চৌধুরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ঐক্যের ডাককে রুটিন কথা মনে হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক মতানৈক্য এতোটা প্রগাঢ় যে, এক বা দুই প্রজন্মে তা ঘুচবে না।”
তাঁর মতে, “প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক মন নিয়ে কথাগুলো বলেছেন ধরে নিলেও যে অর্থে তিনি বলেছেন বিদ্যমান মতানৈক্যের কারণে সেটা নিয়ে আমি খুব আশাবাদি না। তবে মতানৈক্য থাকলেও সেটা যেন সহিংসতায় পর্যবসিত না হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেন বাহল থাকে।”
নতুন নির্বাচন চায় বিএনপি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বিবৃতি দিয়েছেন বলে বেনারকে জানান দলটির চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এই নির্বাচনে মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি এবং ক্ষমতাসীনেরা একটা ভয়াবহ রকমের ভোট ডাকাতি করেছে। এমন ঘটনা ইতিপূর্বে বাংলাদেশ কখনো দেখিনি।”
“সেই ভোটের মাধ্যমে আবার ক্ষমতা দখল করে নিয়ে তারা দেশ পরিচালনা করবেন এবং বলছেন বিরোধী দলকে পার্লামেন্টে যাওয়ার জন্যে। আমি মনে করি, জনগণের সঙ্গে এটা আরো একটা প্রতারণা করা হচ্ছে, মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে,” বলেন মির্জা ফখরুল।
একাদশ সংসদে যাওয়ার বিষয়ে নিজ দলের অবস্থান আবার উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা ফলাফল প্রত্যাখান করেছি। এই মুহূর্তে সংসদ যাওয়ার বা শপথ নেওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না।”
নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেন। সবাই অংশগ্রহণ করবে। তারপরে যে ফলাফল আসবে সেই ফলাফলের ভিত্তিতে সংসদ এবং সরকার গঠন হবে।”
সবার জন্য কাজ করতে চান
এদিকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, “বিজয়ের পর আমরা সরকার গঠন করেছি। সরকারের দৃষ্টিতে দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিক সমান। আমরা সবার জন্য কাজ করব।”
তিনি বলেন, “সরকারি সেবাখাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় জীবনের সর্বত্র আইনের শাসন সমুন্নত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করব। জাতীয় সংসদ হবে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একাদশ সংসদে বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে, সংখ্যা দিয়ে আমরা তাদের বিবেচনা করব না। সংখ্যা যত কমই হোক, সংসদে যে কোনো সদস্যের ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রস্তাব, আলোচনা, সমালোচনার যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। আমি বিরোধীদলের নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিয়ে সংসদে যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছি।”
প্রধানমন্ত্রী গত দুই মেয়াদে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ এবং সাফল্যের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের কারণও উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “বহু উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, যার মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে যে, সাধারণ ভোটারগণ বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং নৌকার অনুকূলে এবার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।”
গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৫৭টি এবং জোটগতভাবে ২৮৮টি আসনে জয় পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে। আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সব মিলিয়ে আটটি আসন পেয়েছে।
তবে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে সংসদে না যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। বিরোধী জোটের নির্বাচিত প্রার্থীরা শপথও নেননি।
জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি, দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অস্বস্তি রয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের নিজেদের শোধরানোর আহ্বান জানাচ্ছি। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে।”
মাদক, জঙ্গি তৎপরতা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযানে সাফল্য পাওয়ার কথা তুলে ধরে তা অব্যাহত রাখার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের এ অংশষ নিয়ে ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, “এর অর্থ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে থাকবে। যা মানবিাধিকার পরিস্থিতির জন্য চিন্তার বিষয়। নতুন সরকার চাইলে বিষয়টি অন্যভাবেও সামাল দিতে পারে।”
“তবে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি কোনো রকমের কটুক্তি ছিল না। এটা বেশ ভালো দিক,” বেনারকে বলেন ড. শান্তনু মজুমদার।