জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দল ও জোটে চলছে ভাঙাগড়া
2018.10.19
ঢাকা

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দল গোছানোর চেয়ে জোট গোছাতেই বেশি তৎপর দুই বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। উভয় দলই নিজেদের পক্ষে ছোট ছোট দলগুলোকে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। এতে একদিকে জোটের ভাঙাগড়া চলছে, আরেকদিকে ছোট দল ভেঙে আরও ছোট হচ্ছে।
সর্বশেষ শুক্রবার ভেঙে গেলো সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা। এর একটি অংশ সরকারবিরোধী মোর্চা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছে, আরেক অংশ সরকারের সঙ্গে যোগ দিতে পারে—এমন গুঞ্জন রয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি—ন্যাপ ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি।
এই দুই দলের নেতারা বৃহস্পতিবার বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
“ছোট দলগুলোর সমর্থক কম থাকলেও অনেকগুলো দল একমঞ্চে জড়ো হলে মানুষের মধ্যে ঐক্যের বার্তা যায়। দলের চেয়ে জোটের ওপর আস্থা জোরালো হয়। এ জন্যই ছোট দলগুলোকে পাশে নিতে চাইছে বড় দুটি দল,” বেনারকে বলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন।
প্রবীন রাজনীতিবিদ এবং কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “দেশে একটা ভারসাম্যের রাজনীতি দরকার। জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার, কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য কিংবা ক্ষমতায় বসানোর জন্য এই ঐক্য নয়।”
কাদের সিদ্দিকী কোন দিকে ঝুঁকবেন তা নিয়ে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। নিজ দলের অবস্থান কী হবে—তা স্পষ্ট করতে রাজি নন তিনি। এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, “আর কিছুদিন পর সব স্পষ্ট হবে।”
নির্বাচন কমিশন বলেছে, নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। গত বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে চার নির্বাচন কমিশনারের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান কমিশনের সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
এর আগে চলতি মাসের ২১ তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে জাতীয় সংসদের সংক্ষিপ্ত ও সর্বশেষ অধিবেশন। এই অধিবেশন শেষে বর্তমান মন্ত্রিসভার আকার ছোট করার কথা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করছে।
যত দল ও জোট
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, বর্তমানে দেশে মোট ১৯৩ টি রাজনৈতিক দল এবং ১৪টি রাজনৈতিক জোট আছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ৩৯ টি।
সর্বশেষ বিএনপি, গণফোরাম, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও নাগরিক ঐক্য মিলে গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এই জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন।
বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান ও তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ১৪-দলের ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’। এই জোট আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে।
জাকের পার্টির চেয়ারম্যান খাজা মোস্তফা আমীর ফয়সাল মুজাদ্দেদী বেনারকে বলেছেন, “আমরা সুফি মতাদর্শ ধারণ করি। এখানে ধর্ম, গোত্র বা সম্প্রদায়ের ঊর্দ্ধে মানুষকে স্থান দেওয়া হয়। এই আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে মেলে। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে আমরা থাকতে চাই।”
এদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ৫৮টি দল নিয়ে সম্মিলিত জাতীয় জোট নামে একটি মোর্চা বানিয়ে রেখেছেন। শনিবার এরশাদ ঢাকায় নির্বাচনী জনসভা ডেকেছেন। তিনি জোটের পরিধি আরও বাড়াতে পারেন বলে শুক্রবার চ্যানেল আইকে জানিয়েছেন পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার।
বর্তমান সরকারের সময়ে গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে পাঁচ বছর পার করেছে জাতীয় পার্টি। এবারও সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে জাপা—রাজনীতিতে এমন ধারণা অনেকটাই পরিষ্কার।
বিএনপির সাবেক নেতা নাজমুল হুদা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্স (বিএনএ) নামে ৩৪–দলীয় একটি জোট করেছেন, বেশিরভাগ দলই নামসর্বস্ব। এই জোটও ক্ষমতাসীন জোটে যুক্ত হতে আগ্রহী।
গত জুলাই মাসে সিপিবি, বাসদ এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ মোট আটটি দল নিয়ে গঠন করা হয় বাম গণতান্ত্রিক জোট। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই জোটের বাইরে তৃতীয় শক্তি গড়ার প্রত্যাশায় নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রাখতে চাচ্ছে এই জোট।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসবে ততই ভাঙা–গড়ার রাজনীতি জোরদার হবে।
“রাজনীতিতে আরও জোট হতে পারে। ১৪টা জোট হয়েছে, ২০–২৫টা হলে অসুবিধা নেই,” সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন কাদের।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করতে অনেকে যোগাযোগ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
জোট গঠনের মূল আকর্ষণ এখন পর্যন্ত প্রধান দুই দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে ঘিরে। তাই দুই দলের নেতারাও একে অপরের সমালোচনা করছেন এই ইস্যুতে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বেনারকে বলেন, “বিএনপি কার সাথে জোট করল তা নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো ভাবনা নেই।”
“যাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, জন সম্পৃক্ততা নেই বিএনপি তাদের সাথে ঐক্য করেছে। এই জোটের আন্দোলন করার ক্ষমতাও নেই,” বলেন হানিফ।
অন্যদিকে বিএনপি'র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর ভাষ্য হলো, “জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হওয়ায় আওয়ামী লীগ কতটা উদ্বিগ্ন তা তাদের সমালোচনার ভাষা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ।”
বিকল্পধারায় বিকল্প দল
বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে নিয়ে ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর রাজনীতিতে ভাঙ্গাগড়া জোরদার হয়েছে।
বিএনপিকে ‘ক্ষমতায় বসানোর ঐক্যে’ নেই—এ কথা বলে বি চৌধুরী ড. কামালের ঐক্যফ্রন্টে যোগাদান থেকে বিরত থাকেন। এরপর বিএনপির জোট থেকে দুটি দল বের হয়ে বি চৌধুরীর সঙ্গে জোট করার ঘোষণা দেয়।
এদিকে বিকল্প ধারা থেকে বহিষ্কৃতরাই শুক্রবার পাল্টা কমিটি গঠন করে দল থেকে বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আবদুল মান্নান ও মাহি বি চৌধুরীকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
বিএনপিকে নিয়ে গঠিত কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন বিকল্প ধারার নেতা অ্যাডভোকেট শাহ আলম বাদল।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের দিনই দলের সহসভাপতি বাদলসহ কয়েকজনকে বহিষ্কার করেছিলেন বিকল্প ধারা সভাপতি বি চৌধুরী। তার এক সপ্তাহের মধ্যে পাল্টা পদক্ষেপ এল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জোটের রাজনীতিতে আদর্শের চেয়ে নির্বাচনে আসন বন্টন, ক্ষমতা আর সুবিধাপ্রাপ্তি মুখ্য বিষয় হয়ে উঠছে।
অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “দেশের স্বার্থে কিংবা সম-আদর্শের কারণে জোট হচ্ছে না। কারও ক্ষমতায় থাকা এবং কারও ক্ষমতা যাওয়ার জন্য জোট।”
রাজনৈতিক এই বিশ্লেষকের মতে, “ক্ষমতা ও স্বার্থের ভাগাভাগির জন্য যখন জোট হয় তখন সেই জোটে দৃঢ়তা থাকবে না—এটাই তো স্বাভাবিক।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি।