সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ ঐক্যফ্রন্ট-সরকার আলোচনা

কামরান রেজা চৌধুরী ও প্রাপ্তি রহমান
2018.11.07
ঢাকা
181107_Dialouge_1000.jpg গণভবনে আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিতীয় দফার সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ। ৭ নভেম্বর ২০১৮।
[সৌজন্যে: বাসস]

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের সাথে বিরোধী রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় ও শেষ দফার আলোচনা বুধবার কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে।

জোট নেতারা জানিয়েছেন, একটি দল-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একাদশ সাধারণ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে’ সম্পন্ন করতে নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙে দেয়ার যে ফর্মুলা তাঁরা দিয়েছেন সরকার সেগুলো গ্রহণ করেনি।

ডিসেম্বরের পরিবর্তে সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ অথবা মার্চের প্রথমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছে ঐকফ্রন্ট। তবে সেই প্রস্তাবনাও নাকচ করে দিয়েছে সরকার।

আগামীকাল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে নির্বাচন কমিশন কার্যালয় অভিমুখে যাত্রা কর্মসূচির ঘোষণা করেছে ঐক্যফ্রন্ট।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন। নির্বাচন কমিশনের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে।

সংলাপ শেষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, সরকার পদত্যাগ করবে না। নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবি অসাংবিধানিক। তাঁরা সংবিধানের বাইরে যেতে পারবেন না।

দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপে সরকারি দলের কাছে ঐক্যফ্রন্ট চারদফা প্রস্তাবনা রাখে।

এতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদার একজন প্রধান উপদেষ্টা ও মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন ১০ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার গঠন করবেন। তাঁদের অধীনে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এদিকে “প্রধান উপদেষ্টাসহ ১০ জন উপদেষ্টা রেখে নির্বাচন করার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়,” বলে সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, “সংসদ যেদিন বসেছে সেদিন থেকে হিসাব করে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তাঁরা সংলাপে প্রস্তাব দিয়েছেন নির্বাচন সংসদের মেয়াদ শেষে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে করার। কিন্তু এটা সংবিধানের বাইরে। তাই আমরা এতে সম্মত হইনি।”

“ডায়ালগ শেষ,” বলে মন্তব্য করলেও ওবায়দুল কাদের জানান, ‘‘আলোচনা আরও হতে পারে।”

রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করার কথা থাকলেও তা অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।

গণভবনে আওয়ামী লীগের সাথে বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় দফার সংলাপ। ৭ নভেম্বর ২০১৮।
গণভবনে আওয়ামী লীগের সাথে বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় দফার সংলাপ। ৭ নভেম্বর ২০১৮।
[সৌজন্যে: বাসস]
দাবি না মানলে আন্দোলন

আগামী নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু; করতে সাত দফা দাবি নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেয় ঐক্যফ্রন্ট। সরকার আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করে।

পয়লা নভেম্বর প্রথম দফা আলোচনা হয়। সেখানে উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন না হওয়ায় বুধবার গণভবনে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় বসে দুপক্ষ। এতে সরকার পক্ষের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐক্যফ্রন্টের ১১ সদস্যের নেতৃত্ব দেন ড. কামাল হোসেন।

সকালে প্রায় তিন ঘণ্টার সংলাপ শেষে দুপুরে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ কামাল হোসেনের বাসায় এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন।

এতে ড. কামাল হোসেন বলেন, “শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। যদি না হয় এর দায় দায়িত্ব সরকারের।”

দ্বিতীয় সংলাপে কী অর্জন হয়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিনএপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”

“আমরা সরকারকে বলেছি আমরা আরও আলোচনা করতে চাই। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আবারও আলোচনা হতে পারে,” জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “সরকার আমাদের দাবি না মানলে আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে সেগুলো আদায়ের চেষ্টা করব।”

সরকারের সাথে চলমান সংলাপ আন্দোলনের একটি অংশ বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।

তিনি জানান, “আগামীকাল যদি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় তাহলে আমরা নির্বাচন কমিশন অভিমুখে যাত্রা করব।”

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “দেখুন সংলাপে কিছু হোক দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে। কিন্তু সেটি হয়নি। আর আলোচনা ব্যর্থ হলে বিরোধী জোট রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হতে পারে।”

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন অভিমুখে যাত্রা কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীকে গায়েবি মামলার তালিকা হস্তান্তর

নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি' বা অদৃশ্য মামলার তালিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পৌঁছে দিয়েছে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। গত ১ নভেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার বিএনপি ওই তালিকা হস্তান্তর করে।

তালিকার পাশাপাশি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। ওই চিঠিতে তিনি তালিকা অনুসারে, গায়েবি মিথ্যা মামলায় নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ করে এসব মামলা প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করেন।

বিএনপি প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মামলার তালিকা ও চিঠি গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী আবদুল হামিদ।

তালিকা হস্তান্তরের পর বিএনপির সহ দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু সাংবাদিকদের বলেন, যে তালিকাটি তাঁরা হস্তান্তর করেছেন সেটি আংশিক।

টিপু বলেন, “জমা দেওয়া তালিকায় ১ হাজার ৪৬টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় বর্তমানে কারাগারে আছেন ৫ হাজার ২৭৪ জন। বিভিন্ন মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ৯৬ হাজার ৭০০, অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা ৩ লাখ ৭০ হাজার।”

উল্লেখ্য, রাজনৈতিক বিবেচনায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করছে–বেশ কিছুদিন ধরে বিএনপি এই অভিযোগ করে আসছিল। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে এই প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হলে, তিনি এসব মামলার তালিকা চান।

এদিকে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

৬ নভেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশকে কেন্দ্র করে আগের দিন থেকে আবারও ধরপাকড় করার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। আদালত সূত্র জানায়, শুধু ৫ নভেম্বরেই ৮৩ মামলায় ১৭১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আর সমাবেশের দিন মঙ্গলবার ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় তিনশ নেতা–কর্মীকে, যাদের বুধবার আদালতে হাজির করা হয়।

নির্বাচনের আগে এ ধরনের মামলা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিএনপি তাঁদের আটক নেতা–কর্মীদের যে তালিকা দিয়েছে, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া সরকারের সদিচ্ছার ওপরেই নির্ভর করছে।”

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।