নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করলো আওয়ামী লীগ
2023.12.14
ঢাকা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে নিজেদের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করলো ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলটির প্রায় ৫০০ নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।
অথচ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ৪৭ নম্বর ধারার ঠ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেহ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হইলে দল হইতে সরাসরি বহিষ্কার হইবেন এবং যাহারা দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করিবেন, তাহারা তদন্তসাপেক্ষ মূল দল বা সহযোগী সংগঠন হইতে বহিষ্কৃত হইবেন।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “দলীয় গঠনতন্ত্রে যা-ই থাকুক না কেন, আমাদের দলের সব নেতা-কর্মীর পূর্ণ আস্থা দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। তিনি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
“আমাদের নেত্রী মনে করেছেন, দেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এই ব্যবস্থাটি প্রয়োজন। তাই তিনি এটি করেছেন, এটা নিয়ে আমাদের আলাদা কোনো বক্তব্য নেই,” বলেন তিনি।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের হিসাবে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে মোট দুই হাজার ৭১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে এক হাজার ৯৮৫ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ এবং ৭৩১ জন প্রার্থীর মনোনয়ন অবৈধ বিবেচিত হয় বাছাই পর্বে।
গত চার দিনে আরও ২৬০ প্রার্থী আপিল করে তাদের প্রার্থিতা ফেরত পেয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের এই আপিল শুনানিতে শুক্রবার শেষ হবে।
আওয়ামী লীগ ও ইসির হিসাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রায় ৭৫০ জন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের প্রতিটিতে আওয়ামী লীগের এক বা একাধিক প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর ব্যাপারে গঠনতন্ত্র উপেক্ষিত হওয়া প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “এই নির্বাচনে বহু কিছুই উপেক্ষিত হচ্ছে। এটি একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। এখানে কোনো কিছুই তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।”
নির্বাচনকে উৎসবমুখর দেখাতে এসব পথ আওয়ামী লীগ বেছে নিয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার মনে করেন, দলীয় গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করার এই ‘ব্যতিক্রম’ সিদ্ধান্ত যেহেতু আওয়ামী লীগ সভাপতিই নিয়েছেন, তাতে খুব একটা সমস্যা হবে না।
সহিংসতা বাড়ার আশঙ্কা
এই দুই বিশ্লেষকই মনে করেন, আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর কারণে সহিংসতা বাড়তে পারে।
“অনেকগুলো আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এতটাই শক্তিশালী যে, কোথাও কোথাও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে,” বলেন শান্তনু মজুমদার।
তিনি মনে করেন, বিরোধীশূন্য ভোটে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই হয়ে উঠতে পারে ভোটের মূল আকর্ষণ।
বদিউল আলম মনে করেন, ক্ষমতাসীন দলের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রার্থীর মধ্যে সহিংসতার ঘটনা নতুন নয় বলে এর পুনরাবৃত্তি এবারের নির্বাচনেও দেখা যেতে পারে।
“সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের ফলে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল আওয়ামী লীগের লোক,” বলেন তিনি।
সর্বশেষ, গত ১১ ডিসেম্বর পিরোজপুর সদর উপজেলায় নৌকার সমর্থকদের হামলায় আহত এক যুবককে লালন ফকির (২৭) মারা যান।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল দাবি করেছেন, লালন ফকির তার কর্মী ছিলেন।
আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক প্রার্থী মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এ প্রসঙ্গে বদিউল আলম বলেন, যে যা-ই দাবি করুক, একটি মানুষ যে মারা গেছে সে কথা তো সত্য। এর মানে সহিংসতার ইঙ্গিত মিলছে।
স্বতন্ত্র সরিয়ে নিতে শরিকদের চাপ, আওয়ামী লীগের না
১৪ দলীয় জোটের শরিকরা তাদের ছেড়ে দেওয়া আসনগুলো থেকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছে। তবে এই দাবি মানতে নারাজ আওয়ামী লীগ।
এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান খুব স্পষ্ট। তারা নির্বাচনে আছে। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শরিকদের দ্বিমত থাকতে পারে। তবে বল প্রয়োগ না করে তাদের নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলতে বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বেনারকে বলেন, “জোটের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রদের সরিয়ে দেওয়ার দাবির মূল কারণ হচ্ছে নির্বাচন যাতে সহিংস হয়ে না ওঠে।”
তিনি বলেন, “আমাদের দাবি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রদেরও সরিয়ে দেওয়া হোক, যাতে করে জোটের ভোটাররা বিভ্রান্ত না হন।”
শরিকদের সাত আসন ছেড়েছে আওয়ামী লীগ
বৃহস্পতিবার রাতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বেনারকে জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে জোটের শরিকদের জন্য সাতটি আসন ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা।
এই সাত আসনে শরিক দলের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
এই সাতটি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বরিশাল-৩, রাজশাহী-২ ও সাতক্ষীরা-১ আসন; জাসদকে দেওয়া হয়েছে কুষ্টিয়া-২, লক্ষ্মীপুর-৪ ও বগুড়া-৪ এবং জাতীয় পার্টিকে (জেপি) পিরোজপুর-২ সংসদীয় আসন।
উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি, নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরসহ আরও কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি। পর্যায়ক্রমে মহানগর, জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা, সমাবেশ এবং মানববন্ধনের পরে দলটি সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
পাশাপাশি ঘোষণা দেয়, দাবি আদায় না হলে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। এই দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া শরিকরাও নির্বাচন বর্জন করেছে।