মজুরি বৃদ্ধির পরও পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় শ্রমিকেরা
2019.01.14
ঢাকা

টানা সাত দিন রাজপথে সহিংস আন্দোলনের মুখে মজুরি কাঠামো পর্যালোচনা করে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সম্মতিতে রোববার পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করে সরকার।
কিন্তু তারপরও শত শত তৈরি পোশাক কারখানা নিয়ে গড়ে ওঠা ঢাকার আশুলিয়া ও গাজীপুরের শিল্প এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ পুরোপুরি থামেনি।
নতুন মজুরি প্রত্যাখ্যান করে সোমবার পুনরায় সকালে হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিক্ষোভ করার চেষ্টা চালায়। তবে পুলিশের তৎপরতার কারণে তারা মহাসড়ক অবরুদ্ধ করতে পারেনি বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
আশুলিয়া ও গাজীপুরের ৩৫টি কারখানায় প্রায় দুই লাখ শ্রমিক কাজে যোগ দিয়ে কিছুক্ষণ পর কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক আব্দুস সালাম।
তিনি বেনারকে বলেন, “আজ অধিকাংশ কারখানার শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিয়েছেন। সাভারে কোনো শ্রমিক প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেনি। তবে, আশুলিয়া ও গাজীপুরের প্রায় ৩৫টি কারখানার শ্রমিকরা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে।”
মহাপরিচালক সালাম বলেন, “তারা হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট, আধঘণ্টা এবং সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা পর চলে গেছে। ওই সকল কারখানার শ্রমিক সংখ্যা হবে প্রায় দুই লাখ।”
কোনো শ্রমিক রাস্তায় বিক্ষোভ বা বিশৃঙ্খলা করতে পারেনি বলেও জানান তিনি।
আবদুস সালাম বলেন, “শ্রমিকরা যাতে সড়ক অবরোধ করতে না পারে সেজন্য আমরা শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছি। তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ করা থেকে বিরত রেখেছি।”
তিনি বলেন, “আসলে শ্রমিকরা কী চান সেটা সাধারণ শ্রমিকরা বলতে পারে না। আমরা বের করার চেষ্টা করছি, কারা তাদের উস্কে দিচ্ছে।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার সকাল থেকেই আশুলিয়ায় জামগড়া, নরসিংহপুর ও বেরন এলাকায় হামিম গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ ও উইনডিসহ বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ দেওয়ার পর বেলা নয়টার দিকে বেরিয়ে আসে।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশের পরিদর্শক মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, সকালে অধিকাংশ কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়। কিন্তু আটটি কারখানার শ্রমিকরা বেরিয়ে এসে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করে। পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, এবং তারা রাস্তা থেকে সরে যায়।
তিনি বলেন, ওই কারখানা কর্তৃপক্ষ এক দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে।
তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের মূল খাত। এই খাতে মোট ৪৪ লাখ মানুষ কর্মরত রয়েছে যাদের অধিকাংশই মহিলা।
সরকারি হিসাবে, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ৩০.৬ বিলিয়ন ডলার এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে।
সন্তুষ্ট নয় শ্রমিকেরা
শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সামছুজ্জামান ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “২০১৮ সালের মজুরি কাঠামো অনুযায়ী গ্রেড তিনের শ্রমিকদের মজুরি ছিল ৯,৫৯০ টাকা। রোববার ত্রিপক্ষীয় কমিটি সেটি বৃদ্ধি করে ৯,৮৪৫ টাকায় নির্ধারণ করেছে। গ্রেড চারের মজুরি ৯,২৪৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৯,৩৪৭ টাকা করা হয়েছে। আর গ্রেড পাঁচের শ্রমিকদের মজুরি ৮,৮৫৫ টাকা থেকে ৮,৮৭৫ টাকা করা হয়েছে।
ভূঁইয়া বলেন, “আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক শ্রমিকদের দাবি আমলে নিয়ে মজুরি বৃদ্ধি করেছি। রোববারের বৃদ্ধির পর কোনো শ্রমিকের মজুরি কমেনি। আমরা চাই সকল শ্রমিক তাদের স্ব স্ব কর্মস্থলে ফিরে কাজে মনোনিবেশ করুন।”
তবে মিরপুর এগারো নম্বর এলাকার একজন পোশাক শ্রমিক আসলাম বেনারকে বলেন, “বলা হচ্ছে রোববার রাতে আমাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। আমি যেই গ্রেডে পড়ি সেই পাঁচ নম্বর গ্রেডে বেতন বেড়েছে বিশ টাকা। তাহলে কী লাভ হলো আমার?”
তিনি বলেন, “আমি মনে করি এধরনের বেতন বাড়ার চাইতে না বাড়াই ভালো। আমরা এই মজুরি মানি না। আমরা চাই আমাদের মূল বেতন বৃদ্ধি করা হোক।”
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বেনারকে বলেন, “হ্যাঁ, হয়তো আমাদের শ্রমিক ভাইবোনদের প্রত্যাশা মোতাবেক মজুরি বৃদ্ধি হয়নি। কিন্তু আন্দোলনে মুখে সরকার প্রকাশিত গেজেট বাতিল করেছে এবং নতুন গেজেট শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। এটি একটি বড় ঘটনা।”
তিনি বলেন, “যদি শ্রমিকরা কাজে ফিরে না গিয়ে রাস্তায় আন্দোলন করে তাহলে আমাদের মালিকরা তাদের অর্ডার রক্ষা করতে পারবে না, এবং ক্রেতারা অন্যান্য দেশে চলে যাবে। আমাদের শিল্প ও দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।”
আমিন বলেন, “শিল্প ধ্বংস হলে শ্রমিকরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের প্রধান নাজমা আক্তার বেনারকে বলেন, “মজুরি বেড়েছে ১৫ টাকা, ২০ টাকা করে। আমরা সেটা মেনেও নিয়েছি। কিন্তু শ্রমিকরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা আশা করেছিল তাদের মূল বেতন বাড়বে, বছরে শতকরা পাঁচ ভাগ করে মজুরি বাড়বে। সেকারণেই আজ বিক্ষোভ হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমরা চাই শ্রমিকরা রাস্তায় না থেকে কারখানায় ফিরে যাক। তারা যেন মামলা-হামলার শিকার না হয়।”
নাজমা আক্তার বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নিজে এই সমস্যা সমাধানে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আমি আশা করি শ্রমিকদের মজুরি যেন প্রতিবছর বৃদ্ধি পায় সে ব্যাপারে তিনি নজর দেবেন।”
তৈরি পোশাক কারখানার মলিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বেনারকে বলেন, আমরা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ও সরাকরের সাথে পর্যালোচনা করে মজুরি বৃদ্ধিতে রাজি হয়েছি। তাই আমরা আশা রাখি শ্রমিক বোন-ভাইয়েরা কাজে মনোনিবেশ করবেন।
মজুরি পুনর্নির্ধারণ উৎসাহব্যঞ্জক: আইএলও
সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণকে উৎসাহব্যঞ্জক বলেছে দ্য ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)। সোমবার এক বিবৃতিতে তারা এ কথা বলেছে।
আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিয়াইনেন বিবৃতিতে বলেছেন, “শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সব পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছাতে এবং যথাযথ হারে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে যে আন্তরিক চেষ্টা করেছে, আমরা তার গুরুত্ব স্বীকার করি। তাদের ত্রিপক্ষীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই খাতে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে এবং আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাই, তারা যেন পুনরায় কাজ শুরু করার সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেন।”