আন্দোলনে জিতে এখন চাকরি হারাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা
2019.01.17
ঢাকা

সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনের পর তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের সামান্য মজুরি বাড়লেও আন্দোলন করার কারণে অনেক কর্মীই বরখাস্ত হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও দেওয়া হচ্ছে।
আন্দোলনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, কারখানার কাজ করতে বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ১০ থেকে ১২টি মামলা করেছেন বলে বেনারকে জানান শিল্প পুলিশের সুপার সানা সামিনুর রহমান।
তিনি জানান, আন্দোলনে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে এ পর্যন্ত সাভার ও আশুলিয়া থেকে ২৫ জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, ১২ জন শ্রমিককে গত মঙ্গলবার জেলে পাঠানো হয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা বলছেন, ট্রেড ইউনিয়ন ও আন্দোলন করার কারণেই চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে কর্মীদের। বরখাস্ত হওয়াদের নাম ও ছবি কারখানার প্রবেশমুখে সাইনবোর্ড দিয়ে প্রদর্শন করা হচ্ছে।
তাঁদের মতে, মজুরি বৃদ্ধি আন্দোলনের কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছেন হাজারের ওপর কর্মী।
তবে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কোনো নিরীহ কর্মী চাকরিচ্যুত হয়নি।
শিল্প পুলিশের সুপার সানা বলেন, “আমরা পুলিশ বাদী হয়ে কোনো মামলা করিনি। বিক্ষোভের সময় যাদের ফ্যাক্টরি ভাঙচুর করা হয়েছে তাঁরাই মামলা করেছেন কর্মীদের বিরুদ্ধে। তাঁরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে মামলা করেছেন।”
তিনি বলেন, “যারা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ করবেন তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হলে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।”
গত ৬ জানুয়ারি থেকে ঢাকার আশুলিয়া, সাভার, মিরপুর, উত্তরা, গাজীপুর এলাকার তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া নতুন মজুরি বোর্ডের বিরুদ্ধে রাস্তায় সহিংস বিক্ষোভ শুরু করেন।
সপ্তাহব্যাপী এই বিক্ষোভে এক শ্রমিক নিহত হন। পুলিশের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত হন কয়েক’শ কর্মী।
কর্মীদের অভিযোগ ২০১৮ সালের মজুরি বোর্ডের কাঠামো অনুযায়ী তাঁরা যে মজুরি পাবেন তার পরিমাণ ২০১৩ সালের মজুরি বোর্ডের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কম।
পোশাক খাতের এই অচলাবস্থা কাটাতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সাথে আলোচনা করে মজুরি বোর্ডের অসামঞ্জস্য দূর করে সরকার। শ্রমিকেরা যোগ দেন কর্মস্থলে।
তবে আন্দোলন থেকে ফিরে অনেকেই চাকরিতে যোগ দিতে পারেননি।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “গত কয়েক দিন আগে মালিক, শ্রমিক ও সরকার এই তিন পক্ষের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আন্দোলনের কারণে কোনো নিরীহ কর্মীকে কিছু করা হবে না।”
“আমি সেই কথাই বলতে চাই যে, কোনো নিরীহ কর্মীকে চাকরিচ্যুত বা হয়রানি করা হয়নি। যারা বলছে, তারা প্রমাণ দেখাক যে তাদের অযথা হয়রানি বা চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “যারা ফ্যাক্টরি ভাঙচুর করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে, চুরি করেছে তাদের রক্ষা করা হবে না।”
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনরে সভাপতি বাবুল আখতার বেনারকে বলেন, “গত কয়েক দিনে গার্মেন্টস কর্মীদের বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় ১৪টি, সাভারে তিনটি এবং গাজীপুরে কমপক্ষে দুটি মামলা হয়েছে। মামলা দায়ের করা হয়েছে শ্রম আইনের ৩০৪ ধারায়।”
তিনি বলেন, “কয়েক দিনে আমার জানা মতে কয়েক’শ কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তাদের নাম ও ছবি সাইনবোর্ডে দিয়ে কারখানার প্রবেশমুখে প্রদর্শন করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “অনেক কর্মী মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”
বাবুল বলেন, এফএনএফ টেক্স ফ্যাশন লিমিটেড ৯১ জন, এআর ফ্যাশন ২৫০ জন, এফজিএস গার্মেন্টস ৯৭ জন, রাইয়ান নিট কম্পোজিট লিমিটেড কমপক্ষে ১০০ জন, অবন্তি কালার টেক ফ্যাক্টিরি ৬০০ জনের বেশি কর্মীকে বরখাস্ত করেছে।
তিনি বলেন, “এ রকম শত শত ফ্যাক্টরি থেকে অসংখ্যক কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং হচ্ছে।”
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বেনারকে বলেন, “আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, মাওনা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার কর্মীকে আন্দোলনের পরে বরখাস্ত করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আন্দোলনের কারণেই তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।”
এফএনএফ টেক্স ফ্যাশন লিমিটেডের চাকরিচ্যুত অপারেটর রবি বেনারকে বলেন, “আমাদের ফ্যাক্টরিতে কোনো ভাঙচুর হয়নি। কিন্তু আমাদের এখানকার ৯১ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের নাম ও ছবি সাইনবোর্ডে দিয়ে দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমি জানি না আমার অপরাধ কী। আমরা যারা ট্রেড ইউনিয়ন করি তাদের চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। আন্দোলনের কারণেই আমাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।”
শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শামসুজ্জামান ভূঁইয়া বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বা হচ্ছে এমন কোনো অভিযোগ কারো কাছ থেকে পাইনি।”
তিনি বলেন, “আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে আমরা সেই ঘটনা তদন্ত করে দেখব এবং ঘটনার সত্যতা পেলে সেই কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।”
শামসুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে কোনো অভিযোগ তদন্ত করতে পারে না। নতুন মজুরি কাঠামোর গেজেট খুব শিগগিরই প্রকাশিত হবে।
তিনি বলেন, “গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রত্যেক ফ্যাক্টরি নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী বেতন দিচ্ছে কি না তা যাচাই করার জন্য কারখানাগুলো পরিদর্শন করব।
“আমরা কর্মীদের সাথে কথা বলব যে তারা সঠিক মজুরি পাচ্ছে কি না। তাদের মজুরি শিট পরীক্ষা করা হবে। কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটলে আমরা সেই মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব,” বলেন শামসুজ্জামান ভূঁইয়া।