পাটকল ও গার্মেন্টসে শ্রমিক অসন্তোষ, উৎপাদন ব্যহত
2019.04.03
ঢাকা

দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ যে শিল্পাঞ্চল থেকে অর্জিত হয়, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বুধবার সেই ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের বেশ কিছু কারখানা সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে অবিলম্বে বকেয়া মজুরি পরিশোধ ও ২০১৫ সালের কাঠামো অনুযায়ী মজুরির দাবিতে খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও নরসিংদীতে বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার শ্রমিক।
বিক্ষোভে ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে শিল্পনগরী খুলনা। বৃহস্পতিবার আবার রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিকেরা।
ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষকে দেশের জন্য একটি অশনিসংকেত বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এখানকার কারখানাগুলো থেকে গত বছর ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৬০ ভাগ।
ঢাকায় শ্রমিক অসন্তোষ
কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় বিদেশিদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ স্থান সাভারের ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে সকাল থেকে কয়েক’শ শ্রমিক কারখানার বাইরে এসে আন্দোলনে যোগ দেন।
আন্দোলনরত এক শ্রমিক নিজেকে আমিনুল পরিচয় দিয়ে বেনারকে বলেন, “আমরা আমাদের হাজিরা ভাতা বৃদ্ধি ও উন্নত খাবারের দাবি করেছিলাম। কিন্তু তারা সেই দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে আজ কারখানা বন্ধ করে দেয়। তাই আমরা রাস্তায় নেমে আসি।”
ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের জনসংযোগ কর্মকর্তা নাজমা বিনতে আলমগীর বেনারকে বলেন, “বুধবার তালিসমান গার্মেন্টস এর শ্রমিকরা কিছু ‘তুচ্ছ ও হাস্যকর’ দাবি আদায়ের নামে কারখানায় গন্ডগোল সৃষ্টি করে।”
তিনি বলেন, “কারখানার মালিক বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। তাঁকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি কারখানা আজকের মতো বন্ধ ঘোষণা করতে বলেন। সেই অনুসারে কারখানা বন্ধ করা হয়। ওই কারখানা গুটিয়ে নেওয়া হয়নি।”
নাজমা বলেন, “ওই আন্দোলনকারীরা নিজেরা কারখানা থেকে বেরিয়ে অন্যান্য কারখানায় যারা কাজ করছিল তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছিল। তাই সমস্যা গুরুতর হওয়ার আগেই আমরা নতুন এলাকার কিছু কারখানা আজকের মতো বন্ধ করে দিয়েছি।”
তিনি বলেন, শ্রমিকদের দাবির মধ্যে রয়েছে, কাজের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিতে হবে, মালিক-শ্রমিক একই ধরনের খাবার খাবে, কাউকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না, তাদের পছন্দমতো অন্যান্য কর্মকর্তাদের বের করে দিতে হবে, ইত্যাদি।
নাজমা বলেন, “ইপিজেডের বাইরের শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির জন্য রাস্তায় নামে। আর আমরা চাওয়ার আগে মজুরি বৃদ্ধি করি।”
তার মতে, “অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য শ্রমিকদের কেউ পেছন থেকে উসকানি দিচ্ছে।”
শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার সানা সামিনুর রহমান বেনারকে বলেন, “আজকে প্রথমবারের মতো এখানে শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছে। আমরা খতিয়ে দেখছি, কেউ পেছন থেকে শ্রমিকদের উসকানি দিচ্ছে কি না।”
তিনি বলেন, “আন্দোলনকারী শ্রমিকেরা কারখানা থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন কারখানার ফটকে গিয়ে কিছু ভাঙচুর চালায়। আজ প্রায় ৪০টির মতো কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”
সামিনুর বলেন, আগামীকাল আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন রাখব।
সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বেনারকে বলেন, “ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের কোম্পানিগুলো শ্রমিকদের ভালো মজুরি দেয়। সেখানে শ্রমিক অসন্তোষ খুব কম হয়। হয় না বললেই চলে।”
তিনি বলেন, “কিন্তু সেখানে শ্রমিক অসন্তোষ আমাদের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। কারণ আমাদের রপ্তানি আয়ের ৬০ ভাগের বেশি আসে সেখানকার কোম্পানিগুলো থেকে আসে। তাই সেখানকার শ্রমিক অসন্তোষ অতিসত্বর মেটাতে হবে।”
পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলন
অর্থ সংকটে আট থেকে ১০ মাস বেতন পাচ্ছেন না রাষ্ট্রায়াত্ব বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের আওতাধীন ২২টি পাটকলের বিভিন্ন শ্রেণির ৫৭ হাজারের বেশি শ্রমিক।
২০১৫ সালে তাদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। তবে অর্থ সংকটের কারণে সেই মজুরি বোর্ড বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিজেএমসি। কারণ মজুরি বৃদ্ধি করা হলে অধিকাংশ শ্রমিকের মজুরি দ্বিগুণ হবে যা দেওয়ার আর্থিক সংগতি বিজেএমসির নেই।
বিজেএমসি সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে পাটকলগুলোর মোট আয় ছিল প্রায় ১,১৮০ কোটি টাকা যার শতকরা ৫৪ ভাগ ব্যয় হয় শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে।
গত বছর জুলাই থেকে এবছর জুন পর্যন্ত পাটকলগুলো লোকসান দিয়েছে ৪৬৬ কোটি টাকা। গত বছর জুলাই থেকে এবছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লোকসান দিয়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা।
বকেয়া মজুরি আদায় ও মজুরি বোর্ড বাস্তবায়নের দাবিতে মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে ৭২ ঘণ্টার আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে শ্রমিকর সংগঠনগুলো।
আন্দোলনের তীব্রতা সবচে বেশি ছিল বিভাগীয় শিল্পশহর খুলনায় যেখানে বিজেএমসির বেশ কিছু পাটকল অবস্থিত।
বুধবার সকাল থেকে রাস্তায় অবস্থান নিয়ে খুলনার সাথে ঢাকাসহ সারা দেশের সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় আন্দোলনরত পাটকল শ্রমিকেরা।
আমিন জুট মিলের সিবিএ নেতা আরিফুর রহমান বেনারকে বলেন, “কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে, আমাদের বকেয়া মজুরি দেওয়া হবে। ২০১৫ সালের মজুরি বোর্ড বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু তারা তাদের কথা রাখেননি।”
তিনি বলেন, “আমরা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছি। আট-দশ মাস বেতন নাই। আমাদের সংসার চলছে না। অনেকে অভুক্ত রয়েছে। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাস্তা থেকে সরে যাব না।”
তিনি বলেন, “আমাদের শ্রমিকেরা খুলনাকে ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। দাবি আদায় না হলে আগামীকাল আবার আমরা রাস্তায় নামব।”
বিজেএমসির অর্থ পরিচালক তৌহিদ হাসনাত খান বেনারকে বলেন, “আমরা এখনো শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারিনি। তবে, বিষয়টি সরকারে উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সরকারের পক্ষ আমাদের জানানো হয়েছে, সমস্যাটি অচিরেই সমাধান হবে। আমাদের বলা হয়েছে, আমরা যেন শ্রমিকদের এই বার্তা পৌঁছে দিই যে তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। তারা যেন রাস্তা থেকে সরে যায়।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার সকাল থেকে খুলনার বিভিন্ন অংশে শ্রমিকেরা লাঠি-বাঁশ নিয়ে রাস্তায় অবস্থান নেয়। তারা যশোর-খুলনা হাইওয়ে দখল করে নেয়।
ফলে খুলনা থেকে কোনো বাস-ট্রাক চলাচল করেনি। আবার শ্রমিকেরা খুলনা স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন ছাড়তে দেয়নি।
চট্টগ্রামে হাটহাজারি ও সীতাকুণ্ড এলাকায় বিজেএমসির আওতাধীন নয় পাটকলের শ্রমিরকরা রাস্তায় অবস্থান নিলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকাগামী ট্রেনগুলো বন্ধ করে দেয়। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনও বন্ধ করে দেয়।
রাজশাহীতে জুট মিলস শ্রমিকেরা ঢাকা-রাজশাহী এবং রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়ক বন্ধ করে দেয়।
নরসিংদীতে বিজেএমসির দুটি পাটকলের শ্রমিকেরা ঘোড়াশাল এলাকায় বকেয়া মজুরির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে।