পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা: এক মাস সময় পেলো অ্যাকর্ড

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.04.15
ঢাকা
190415_Accord_1000.JPG ঢাকার একটি পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকরা। ২৯ মে ২০১৩।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

তৈরি পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করা ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট ‘অ্যাকর্ড’ আরো এক বছর বাংলাদেশে থাকবে কি না তা ঠিক করতে এক মাস সময় দিয়েছে আদালত।

অ্যাকর্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য সোমবার তৃতীয়বারের মতো শুনানি পিছিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এব্যাপারে আগামী ১৯ মে শুনানি হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।

আইনজীবীরা জানান, সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য রায় দেবার জন্য আদালত চায়, অ্যাকর্ডের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সরকার ও মালিকপক্ষ একটি ঐক্যমত্যে আসুক।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সোমবার বেনারকে বলেন, “আদালত বলেছে কারখানার মালিকরা যেন আলোচনার মাধ্যমে অ্যাকর্ডের সময় বৃদ্ধির বিষয়ে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসেন।”

তিনি বলেন, “বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে তাদের দেয়া আট শর্তের ব্যাপারে অ্যাকর্ডের সাথে সভা করেছে। আমি যেটা জানি, এব্যাপারে কিছু অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আমার মনে হয়, আদালতে আগামী ১৯ মে’র শুনানির আগে দুইপক্ষই আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আসবে।”

আদালতে শুনানির আগে গত বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ড ভিত্তিক ২০০ ক্রেতাদের আন্তর্জাতিক দায়িত্বশীল বাণিজ্য জোট (আইআরবিসি) বাংলাদেশে অ্যার্ডকে আরও থাকার অনুমতি দিতে আদালতের প্রতি আহ্বান জানায়।

একইসাথে তারা অভিযোগ করে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো অ্যাকর্ডের অর্থ ছাড় করছে না।

অ্যাকর্ডের অর্থ ছাড়ের ব্যাপারে টিপু মুনশি বলেন, “এমন বিষয় আমার জানা নাই।”

অ্যাকর্ড কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানির ২০ বিলিয়ন ডলার আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭ দেশ থেকে।

এই খাতে বর্তমানে নিয়োজিত রয়েছে ৪০ লাখ শ্রমিক।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে সাড়ে এগারো’শ মানুষের প্রাণহানিতে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি সামনে চলে আসে।

বাংলাদেশ থেকে ‘রক্তাক্ত পোশাক’ না কিনতে ইউরোপ ও আমেরিকায় সমাবেশ চলতে থাকে। সরকার ও ভোক্তাদের চাপে পড়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ক্রয় করা কোম্পানিগুলো।

এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানা নিরাপদ করতে ইউরোপীয় ক্রেতারা অ্যাকর্ড এবং উত্তর আমেরিকার ক্রেতারা অ্যালায়েন্স নামক জোট গঠন করে।

কারখানা পরিদর্শন করে সেগুলো কীভাবে নিরাপদ করা যায় সেব্যাপারে কারিগরি সিদ্ধান্ত দেয়া ছাড়াও কোন কোন কারখানা বন্ধ করতে হবে সে বিষয়ে সুপারিশের কর্তৃত্ব দেয়া হয় অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ডকে।

তাদের সুপারিশে কয়েক’শ কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়।

ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে হলে, কারখানা নিরাপদ কি না সেব্যাপারে সনদ নিতে হয় অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ডের কাছ থেকে।

পাঁচ বছর কাজ করে বাংলাদেশের তৈরি কারখানাগুলোকে ‘নিরাপদ’ আখ্যা দিয়ে গতবছর বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে অ্যালায়েন্স। তবে অ্যাকর্ড বলছে তারা আরো থাকতে চায়।

অ্যাকর্ডের একটি সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করে স্মার্ট জিন্স নামক একটি কোম্পানি।

স্মার্ট জিন্স-এর অভিযোগ ছিল অ্যাকর্ড চুক্তির শর্ত ভেঙেছে। চুক্তি অনুযায়ী কোনো কারখানাকে অ্যালায়েন্স সনদ দিলে অ্যাকর্ড আর সেখানে পরিদর্শনে যাবার কথা নয়।

“কিন্তু অ্যালায়েন্সের ‘সম্পূর্ণ নিরাপদ’ সনদ থাকার পরও অ্যাকর্ড স্মার্ট জিন্স কারখানাকে ‘অনিরাপদ’ বলে মতামত দেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে স্মার্ট জিন্সের সাথে চুক্তি বাতিল করে ক্রেতারা,” বেনারকে বলেন স্মার্ট জিন্স এর আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ।

স্মার্ট জিন্স এর মামলার প্রেক্ষিতে গতবছর মে মাসে দেয়া এক রায়ে ৩০ নভেম্বর ২০১৮ তারিখের পর অ্যাকর্ডকে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে বলে হাই কোর্ট।

তবে ২৯ নভেম্বর অ্যাকর্ড এর আপিলের প্রেক্ষিতে প্রথমে এক মাস এবং পরে শুনানির তারিখ অনুযায়ী সংগঠনটি বাংলাদেশে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে বলে সুপ্রিম কোর্টের রায় পায়। সর্বশেষ শুনানির তারিখ ছিল ১৫ এপ্রিল যা পিছিয়ে নতুন করে ১৯ মে নির্ধারণ করা হয়েছে।

আদালত কেন বার বার সময় বৃদ্ধি করছে এমন প্রশ্নে জবাবে জৈষ্ঠ্য ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ওয়াজেদুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “আদালত চায় অ্যাকর্ডের সাথে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করুক মালিকপক্ষ ও সরকার। যাতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কোনো সমস্যা না হয়।”

বেনারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ অ্যাকর্ড ফাউণ্ডেশনের প্রধান রব ওয়াইয়ের মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি কোনো জবাব দেননি।

সরকার-মালিকদের দেয়া শর্ত

২৯ নভেম্বর আটটি শর্তে অ্যাকর্ডকে আরও একবছর বাংলাদেশে কাজ করা অনুমতি দেয়া যেতে পারে বলে সুপ্রিম কোর্টে একটি সিভিল পিটিশন দাখিল করে স্মার্ট জিন্স।

ওই আট শর্তের প্রতি সমর্থন জানায় কারখানা মালিক ও সরকার।

স্মার্ট ‍জিন্সের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরিফ বেনারকে বলেন, “আমরা আট শর্তে বাংলাদেশে অ্যাকর্ডের সময় বৃদ্ধির ব্যাপারে রাজি। আমরা ওই আট শর্ত আদালতে দাখিল করেছি।”

স্মার্ট জিন্সের দেয়া আট শর্ত সংবলিত কার্যপত্রটি বেনারনিউজের কাছে রয়েছে।

এই শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, অ্যাকর্ডের জন্য এই এক বছরের পর আর সময় সম্প্রসারণ করা যাবে না। আগে তারা যেসকল কারখানার উন্নয়নে কাজ করেছে, এই এক বছরে সেগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করবে।

একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির সমস্যার কারণে ওই গ্রুপের সকল কারখানাকে শাস্তি দেয়া যাবে না। অ্যাকর্ড শ্রম মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটির সাথে পরামর্শ না করে কোনো কারখানার সাথে চুক্তি বাতিল করতে পারবে না।

শর্ত হিসাবে আরও বলা হয়েছে, কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ হিসেবে অ্যাকর্ড ও মালিকরা সরকারের কলকারখানা অধিদপ্তরকে মেনে নেবে। এছাড়া ‘অ্যালায়েন্স’ যেসকল কারখানা পরিদর্শন করে নিরাপদ বলে চিহ্নিত করেছে সেগুলোতে আর নিরাপত্তা পরীক্ষা করতে যাবে না অ্যাকর্ড।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা মনে করি আমরা যে আট শর্ত দিয়েছি সেই শর্ত মেনে অ্যাকর্ডের বাংলাদেশে থাকা উচিত।”

তিনি বলেন, “আমরা মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকে অ্যাকর্ডের সাথে একাধিক সভা করেছি। কিছু কিছু জায়গায় মতানৈক্য আছে। তবে আমরা আশা করি আলোচনায় অগ্রগতি হবে। এবং আদালত আমাদের মতামতের ভিত্তিতে একটি রায় দেবেন যা মালিক, সরকার ও অ্যাকর্ড সবাই মেনে নেবে।”

সিদ্দিকুর বলেন, “আমারও চাই আমাদের কারখানাগুলো নিরাপদ হোক। ইউরোপীয় বাজারে আমাদের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি হোক।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।