আত্মহত্যা করলেন রানা প্লাজার উদ্ধারকর্মী হিমু
2019.04.26
ঢাকা

আত্মহত্যা করেছেন সাভারের রানা প্লাজায় উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবক নওশাদ হাসান হিমু (২৭), যিনি ‘হিমালয় হিমু’ নামে পরিচিত ছিলেন। রানা প্লাজা ধসের ছয় বছর পূর্তির দিন গত ২৪ এপ্রিল রাতে সাভারের বিরুলিয়ায় নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।
হিমুর স্বজন ও বন্ধুরা জানিয়েছেন, রানা প্লাজায় উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়ার পর থেকেই মানসিক অস্থিরতা ও ট্রমায় ভুগছিলেন হিমু। গত ছয় বছরেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি তিনি।
উদ্ধারকাজ ছাড়াও পরবর্তীতে হতাহত শ্রমিকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায় এবং রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।
হিমুর এক সময়ের রুমমেট সানাউল কবির শান্ত বেনারকে বলেন, “হিমু চলে গেছে রানা প্লাজার ছয় বছর পূর্তির দিনটিতে। সেদিন রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষের সামনে ওই ঘটনার বিচার না পেয়ে অনেকে মানববন্ধন করছিলেন।”
“রানা প্লাজা ধসের পর হিমু বহু মানুষকে উদ্ধার করেছিল। আটকা পড়া পোশাক শ্রমিকদের শরীরে বিভিন্ন অংশ কেটে কেটে বের করেছিল। এতদিন পরেও ওই ঘটনার বিচার না হওয়া তাকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে।”
তবে এটাই একমাত্র কারণ নয় বলে মনে করেন তিনি।
“হিমুর অভিমান আসলে সমাজব্যবস্থার সাথে, রাষ্ট্রের সাথে, ক্ষমতাসীন দলের সাথে, প্রেমিকার সাথে, আপনার-আমার সাথে,” বলেন তিনি।
“রানা প্লাজায় উদ্ধার কাজের হতাশা থেকেই হিমু আত্মহত্যা করেছে- এটা আসলে তার দলের রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা,” মনে করেন সানাউল কবির শান্ত।
প্রসঙ্গত, হিমু ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা মহানগর শাখার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
হিমুর কয়েকজন বন্ধু জানান, রানা প্লাজায় উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়ার পর থেকেই ভেঙে পড়া ওই ভবনের ভেতরের মৃতদেহ, কাটা হাত-পা এসব স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত।
পরে হতাহত শ্রমিকদের চিকিৎসা-ক্ষতিপূরণ না পাওয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয় তাঁকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াতো।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “শুধু রানা প্লাজা উদ্ধার কাজই হিমালয় হিমুর আত্মহত্যার মূল কারণ নাও হতে পারে। তার যে জীবনযাত্রার কথা পত্রিকায় পড়লাম, তা স্বাভাবিক ছিল না। প্রথম থেকে তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন ছিল।”
“এ ধরনের সমস্যাকে আঘাত পরবর্তী মানসিক সমস্যা বলা হয়। যেকোনো ট্রমা ঘটার ছয়মাস পর থেকেই এই সমস্যা শুরু হতে পারে। যথাযোগ্য ডায়াগোনোসিস এবং সেবার আওতায় আনার মাধ্যমে এ ধরনের সমস্যায় ভোগা মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সুযোগ আছে,” বলেন তিনি।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, বেঁচে ফেরা শ্রমিকেরাও এখনো মানসিক অস্থিরতা আর ট্রমায় ভুগছেন। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে রানা প্লাজার উদ্ধারকাজে অংশ নিয়ে সম্ভবত হিমু সাইকো ট্রমায় ভুগছিল। তাঁর মতো আরো অনেক উদ্ধারকারীসহ আরো কিছু শ্রমিক যারা বেঁচে ফিরেছে, পঙ্গুত্ব বরণ করে তারাও সাইকো ট্রমায় ভুগছে।”
“এদের কে কী অবস্থায় আছে, তাদের বয়স বুঝে উপযুক্ত ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা প্রয়োজন,” বলেন এই শ্রমিক নেতা।
যেভাবে মারা গেলেন হিমু
বরিশাল জেলার উজিরপুর থানার বাবরখানা গ্রামের সরদার আবুল হোসেনের ছেলে হিমালয় হিমু। সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় একা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন রানা প্লাজা ধসের পর উদ্ধার কাজে অংশ নিয়ে ‘হিরো' হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই তরুণ।
স্থানীয়রা জানান, বুধবার রাত পৌনে ১০টার দিকে হঠাৎই হিমুর বাড়ির পাশে আগুন দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের পাশে মেহগনি গাছের নিচে হিমুর শরীরে আগুন জ্বলছে। সঙ্গে সঙ্গে বালু ও পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলা হলেও শেষ রক্ষা হয়নি হিমুর।
সাভার মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আজগর আলী সাংবাদিকদের জানান, ধারণা করা হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরেই এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।”
ফেসবুক জুড়ে ছিল মৃত্যুর আভাস
গত কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে হিমুর দেওয়া স্ট্যাটাসগুলো জুড়েই রয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুর পূর্বাভাস।
‘কোনো মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’, ‘ছোটকাল থেকেই আগুন আমার অনেক পছন্দ, ‘আগুন সর্বগ্রাসী তাই ভালোবাসি’- একের পর এক নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এমন সব স্ট্যাটাস দিয়ে গেছেন তিনি।
ডা. হেলাল উদ্দিন বলছিলেন, “যখন থেকেই সে ফেসবুকে মৃত্যুর কথা বলতে শুরু করল তখন থেকে তাঁর কাছের লোকদের উচিত ছিল বিষয়টাকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া। কারণ, কোনো ধরনের মৃত্যুর ইচ্ছাই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।”