অ্যাকর্ড এর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায় সুপ্রিম কোর্ট
2018.12.18
ঢাকা

সরকার ও তৈরি পোশাক মালিকদের সাথে চলমান বিবাদ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা যায় কি না তা খতিয়ে দেখতে ইউরোপীয় ক্রেতা ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের জোট অ্যাকর্ডকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত।
২০২১ সালের ৩১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে থাকতে গেলে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে সেগুলো তারা মানতে পারবে কি না সে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য অ্যাকর্ডকে ওই সময় বেঁধে দেওয়া হয় বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানিয়েছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
তিনি বলেন, “আগামী ২১ জানুয়ারি অ্যাকর্ডের মতামত জেনে পুনরায় এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি করবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সেদিন হয়তো জানা যাবে অ্যাকর্ড বাংলাদেশে থাকবে কি না।”
অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স কী?
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসে ১ হাজার ১৫০ জনের বেশি শ্রমিক নিহত হলে বাংলাদেশ থেকে ‘রক্ত মাখা’ তৈরি পোশাক না কিনতে চাপের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ক্রেতারা অ্যাকর্ড ও আমেরিকার ক্রেতারা অ্যালায়েন্স নামক দুই জোট গঠন করেন।
তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে সেগুলোর কর্মপরিবেশ শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ করার সুপারিশ করা ও সেগুলো বাস্তবায়ন করা।
মামলা কেন?
মামলার শুরু চট্টগ্রামের তৈরি পোশাক কারখানা স্মার্ট জিন্সকে কেন্দ্র করে।
প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ বেনারকে বলেন, “ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করে ‘সম্পূর্ণ নিরাপদ’ বলে সনদ দেয় অ্যালায়েন্স।
তিনি বলেন, “অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ডের মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ চুক্তি আছে, অ্যালায়েন্স যে ফ্যাক্টরিকে নিরাপদ বলে সনদ দেবে অ্যাকর্ড সেখানে পরিদর্শনে যাবে না অথবা অ্যালায়েন্সের দেয়া সনদকে প্রত্যাখ্যান করবে না অ্যাকর্ড।”
“কিন্তু অ্যালায়েন্সের ‘সম্পূর্ণ নিরাপদ’ সনদ থাকার পরও অ্যাকর্ড স্মার্ট জিন্স কারখানাকে ‘অনিরাপদ’ বলে মতামত দেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে স্মার্ট জিন্সের সাথে চুক্তি বাতিল করে ক্রেতারা,” তিনি জানান।
আইনজীবী শরীফ বলেন, “আমরা অ্যাকর্ডের এই কাজের বিরুদ্ধে ও চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হই। মে মাসে আদালত তাদের ছয় মাস সময় দিয়ে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে অ্যাকর্ডকে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে আদেশ দেয়। ওই আদেশের বিরুদ্ধে অ্যাকর্ড গত ২৯ নভেম্বর আপিল বিভাগে আপিল করে।”
এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে প্রথমে ৬ ডিসেম্বর ও পরে ১০ ডিসেম্বর শুনানির দিন ধার্য করে আপিল বিভাগ। ১৭ ডিসেম্বর ও ১৮ ডিসেম্বর শুনানি হয়।
সরকারের দেয়া নতুন শর্ত
সোমবার ও মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
তিনি মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমি আদালতে বলেছি, অ্যাকর্ড বাংলাদেশে থাকতে গেলে তাদের কাজের ব্যাপারে টিএমসির (ট্রানজিশনাল মনিটরিং কমিটি) সাথে পরামর্শ করে করতে হবে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারবে না। টিএমসিতে অ্যাকর্ড, আইএলও, সরকার, মালিকপক্ষ, ক্রেতা সকলের প্রতিনিধিত্ব আছে।”
তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, অ্যাকর্ডের স্টিয়ারিং কমিটিতে বাংলাদেশ সরকার ও মালিকদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সেখানে সরকার ও মালিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।”
মুরাদ রেজা বলেন, “আদালতে আরও বলেছি, অ্যালায়েন্সের সাথে আলোচনা করে পরিদর্শনের ব্যাপারে একটি একক নীতিমালা নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, অ্যালায়েন্সে একটি কারখানা পরিদর্শন করে বলবে ‘ডান দিকে সিঁড়ি করতে হবে’। আবার পরদিন অ্যাকর্ড এসে বলবে ওই কারখানায় ‘বাম দিকে সিঁড়ি করতে হবে,’ এটা গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিনি বলেন, “আদালত আজ অ্যাকর্ডকে বলেছেন, আমাদের দেয়া শর্তগুলো তারা মানতে পারবে কি না নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আদালতকে জানাতে। অ্যাকর্ড বলেছে তারা জানাবে। আলোচনার জন্য ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে আদালত। ২১ জানুয়ারি আপিল বিভাগে এ ব্যাপারে পরবর্তী শুনানি হবে।”
তিনি বলেন, “সরকার ও মালিকেরা চায় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হোক। প্রয়োজনে অ্যাকর্ড নেদারল্যান্ডস অফিসের কর্মকর্তারা সরকার ও মালিকদের সাথে আলোচনায় বসতে পারে।
অ্যাকর্ডের বিরুদ্ধে মামলাকারী প্রতিষ্ঠান স্মার্ট জিন্সের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরিফ বেনারকে বলেন, “আমরাও অ্যাকর্ডের সাথে বিবাদ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলতে চাই।”
অ্যাকর্ড বাংলাদেশ প্রধান রব ওয়াইস আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তবে তিনি অথবা তাঁর আইনজীবী কেউই সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেননি। মঙ্গলবার রবের কাছে মন্তব্যের জন্য ই-মেইল পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
তবে ৩ ডিসেম্বর পাঠানো এক ই-মেইলে রব বেনারকে জানান, “অ্যাকর্ড আশা করে, বাংলাদেশ সরকার ও তৈরি পোশাক কারখানা মালিকেরা মাঝপথে অ্যাকর্ডের বাংলাদেশ কার্যালয় বন্ধের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেবে, এবং বাকি কারখানাগুলোর নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।”
তিনি বলেন, “অ্যাকর্ডের সহযোগী কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে নিরাপদ ও টেকসই করতে বদ্ধ পরিকর। এবং তারা যেসব কারখানা থেকে পণ্য কেনে সেগুলোতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করবে এবং নিরাপদ থাকবে।”
‘পোশাক কারখানা নিরাপদ হয়েছে’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন খান বেনারকে বলেন, “রানা প্লাজা ধসের পর অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ডের তদারকির কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো নিরাপদ হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকেরা আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।”
জ্যেষ্ঠ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ওয়াজেদুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “গত পাঁচ বছর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার কর্ম পরিবেশ উন্নয়নে অনেক ভূমিকা রেখেছে।”
“আমি মনে করি শ্রমিকদের জন্য কর্মপরিবেশ নিরাপদ করতে অ্যাকর্ডের তদারকি দরকার আছে। তবে সেটা যে দেশের মধ্যে অফিস রেখে করতে হবে তার কোনো মানে নেই। তারা বাইরে থেকেও কাজটি করতে পারেন,” বলেন তিনি।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বেনারকে বলেন, “রানা প্লাজা ধ্বংসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড ২০১৩ সাল থেকে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছে। এবং বাংলাদেশের অনেক কারখানা নিরাপদ করতে সরকার ও মালিকদের সহায়তা করেছে। তাদের সুপারিশে অনেক কারখানা বন্ধ করা হয়েছে।”
প্রতিমন্ত্রী চুন্নু বলেন, “তবে আমরা মনে করি তাদের আর থাকার প্রয়োজন নেই। মালিকরাও তাই মনে করেন। এ বছর মে মাসে অ্যাকর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাদের ছয় মাসের জন্য বাড়তি সময় দেয়া হয়েছে। এখন তাদের পক্ষ থেকে আরও তিন বছর বাংলাদেশে থাকার কথা বলা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আদালত যে রায় দেবে আমরা তা মেনে নেব। আদালত বললে অ্যাকর্ড থাকবে। না বললে থাকবে না। তবে আমরাও চাই আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হোক।”
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বেনারকে বলেন, অ্যাকর্ড গত পাঁচ বছর আমাদের ফ্যাক্টরির পরিবেশ উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছে। অ্যালায়েন্স এ বছরের মধ্যে চলে যাচ্ছে। তবে অ্যাকর্ড আরও থাকতে চায়।”
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “আমরা তাদের কাছ থেকে নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিয়েছি।”
তিনি বলেন, “অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড আমাদের মালিকেরা পছন্দ করেনি। এখন আমাদের অবস্থান হলো, আদালত যা বলবে আমরা তাই মেনে নেব।”