ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রেনিটিডিন উৎপাদন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.11.14
ঢাকা
191114_Renitidine_Banned-1000.JPG নওগাঁ জেলার মান্দা থানার প্রসাদপুর হাটে মাটিতে বসে ওষুধ বিক্রি করছেন এক বিক্রেতা। দামে সস্তা হওয়ায় গ্যাসট্রিক-আলসারের ওষুধ হিসেবে সদ্য নিষিদ্ধ রেনিটিডিন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ১৪ এপ্রিল ২০১৮।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক এন-নিট্রোসডিমিথাইলামাইন (এনডিএমএ) এর পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি থাকায় বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত গ্যাসট্রিক-আলসারের ওষুধ রেনিটিডিন আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়েছে।

এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দিনই ঢাকার বাজার থেকে রেনিটিডিন ওষুধ তুলে নেয়া শুরু করেছে ওষুধ কোম্পানিগুলো।

ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির হিসেবে, বাংলাদেশে রেনিটিডিনের বাজার ২১২ কোটি টাকা। তবে বাজার তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও গ্রামাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ নিয়মিত রেনিটিডিন সেবন করে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

এই নিষেধাজ্ঞা তাঁদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করবে বলে তাঁরা জানান।

ওষুধ প্রশাসন বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, রেনিডিনের কাঁচামাল ভারত থেকে আমদানি করা হয়।

বলা হয়, ভারতের মেসার্স সারাকা ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড এবং মেসার্স এসএমএস লাইফসায়েন্স থেকে আমদানি করা রেনিটিডিন হাইড্রোক্লোরাইড কাঁচামাল (এপিআই) এবং ওই কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত ওষুধের নমুনা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করেছে অধিদপ্তর।

“পরীক্ষার ফলাফলে পরীক্ষাকৃত কাঁচামাল ও ফিনিশড প্রডাক্টে NDMA impurity গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া যায়।”

আর সে কারণে জনস্বার্থে দেশে সব ধরনের রেনিটিডিন জাতীয় ওষুধ উৎপাদন, বিক্রি, বিতরণ ও রপ্তানি স্থগিত করার কথা জানানো হয় গণবিজ্ঞপ্তিতে।

গ্যাস্ট্রিক-আলসারের চিকিৎসার জন্য সারাবিশ্বে জনপ্রিয় এই রেনিটিডিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি এই ওষুধ প্রবর্তন করে। তবে, এবছর সেপ্টেম্বরে রেনিটিডিনের ব্যাপারে রেড অ্যালার্ট জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে রেনিটিডিন নিষিদ্ধ।

ল্যাবএইড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সাবেক অপারেশন প্রধান মিতা বোস বেনারকে বলেন, “বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় রেনিটিডিন একটি ভালো ওষুধ হিসাবে পরিগণিত ছিল। এই ওষুধটি গ্যাসট্রিক-আলসার ও হার্ট বার্নের জন্য ভালো কাজ করত।”

তিনি বলেন, “কিন্তু এবছর সেপ্টেম্বরে রেনিটিডিন সম্পর্কে রেড অ্যালার্ড জারি করে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ইউরোপীয় ড্রাগ প্রশাসনও একই কথা জানায়।”

মিতা বোস বলেন, “রেড অ্যালার্ট জারি করার কারণ হলো, রেনিটিডিনে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান আছে। এরপর থেকে এই ড্রাগ নিয়ে হইচই শুরু হয়। ভারতে এই ড্রাগস নিষিদ্ধ।”

সর্বশেষ ওষুধ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক জরিপ (জুন ২০১৯) উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মোট ওষুধের বাজার ২২ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা।

ওষুধের মোট বাজারের মধ্যে গ্যাসট্রিক-আলসার গ্রুপের সকল ওষুধের বাজার তিন হাজার ১৭১ কোটি টাকা। আর গ্যাসট্রিক-আলসার গ্রুপের ওষুধের মধ্যে রেনিটিডিনের বাজার ২১২ কোটি টাকা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওষুধ প্রশাসনের আওতাধীন ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথ এর ওষুধ পরীক্ষা পরীক্ষাগারের সাবেক সরকারি বিশ্লেষক ড. আবু বক্কর সিদ্দিক বেনারকে বলেন, রেনিটিডিনের বাজার গ্যাসট্রিক-আলসার গ্রুপের অন্যান্য ওষুধের চেয়ে কম।

তিনি বলেন, “কিন্তু এগুলোর দাম অন্যান্য ভালো ওষুধের চেয়ে অনেক কম। সেকারণে গ্রামাঞ্চলে এই ওষুধ ব্যাপকভাবে প্রচলিত। দেখা যায়, দরিদ্র মানুষগুলো গ্রামের ওষুধের দোকানে গিয়ে গ্যাসের ওষুধ চাইলে দোকানি রেনিটিডিন দেয়। তারা বেশি দামি ওষুধ কিনতে পারে না।”

ড. আবু বক্কর বলেন, “রেনিটিডিন জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা বহুবার এই ওষুধ সম্পর্কে বিভিন্ন মহলে বলেছি। কিন্তু এই ওষুধ বন্ধ করা হয়নি। বিভিন্ন ছোট-বড় কোম্পানিগুলো এই ওষুধের উৎপাদন এবং বিক্রি অব্যাহত রেখেছে।”

তিনি বলেন, “গ্রামাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ রেনিটিডিন নিয়মিত সেবন করে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। এই ওষুধ এক টাকা দেড় টাকায় পাওয়া যায়। সরকার এই ওষুধ বন্ধ করে দেশের দরিদ্র মানুষকে বিরাট বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন বলে আমি মনে করি।”

আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, “এখন গ্যাসট্রিক-আলসারের চিকিৎসায় অনেক নিরাপদ ওষুধ এসেছে। ডাক্তারদের কাছে এখন এগুলোর অনেক বিকল্প আছে।”

মিরপুর সাড়ে এগারো পল্লবী শপিং কমপ্লেক্সে আয়েশা মেডিসিন হলের ওষুধ বিক্রেতা মো. আসাদ বেনারকে বলেন, “অপসোনিনসহ কয়েকটি বড় কোম্পানির তৈরি রেনিটিডিন ওষুধ আমরা বিক্রি করি। আমরা এখানে যত গ্যাসের ওষুধ বিক্রি করি তার একটি বড় অংশ রেনিটিডিন।”

তিনি বলেন, “মূলত দরিদ্র শ্রেণির মানুষ এই ওষুধ ব্যবহার করেন। কারণ এই ওষুধ দুই টাকায় পাওয়া যায়। যারা ধনী ও সচেতন তারা সাধারণত রেনিটিডিন কেনেন না। অন্যান্য নিরাপদ ওষুধ কেনেন।”

আসাদ বলেন, “রেনিটিডিন নিষিদ্ধ ছিল না বিধায় আমরা বিক্রি করতাম। আজ বৃহস্পতিবার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করার পর কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাঁদের কোম্পানির রেনিটিডিন ওষুধ আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। আমরা আর রেনিটিডিন বিক্রি করব না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।