ভোটার কম, ঢাকার দুই সিটি সরকারের কব্জায়
2020.02.01
ঢাকা

বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি, বিরোধী প্রার্থীর প্রতিনিধিদের মারধর এবং কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার নানা অভিযোগের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী সুনিশ্চিত বিজয়ের পথে রয়েছেন। রাত এগারোটা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত বেসরকারি ফলাফলে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
রিটার্নিং কর্মর্কতার কার্যালয় থেকে ফল ঘোষণার আগেই নৌকা প্রতীকের দুই মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলাম শনিবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা বিজয়ের জন্য দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানান।
প্রথমবারের মতো কাগজের ব্যালট পেপারবিহীন এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভএম) অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল কম। এ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নুরুল হুদা বলেছেন, তাঁর ধারণা ভোটের হার ৩০ শতাংশের কম হবে। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “এত কম ভোটার উপস্থিতিতে এমন ভোট আমরা চাইনি, চাইও না।”
“আমরা পরিবেশ সৃষ্টি করেছি। কিন্তু ভোটার আনার ব্যাপারে প্রার্থীদের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি,” উল্লেখ করেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের এপ্রিলে ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে গড় ভোট পড়েছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “দেশের ইতিহাসে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এত কমসংখ্যক ভোটার উপস্থিতি আগে দেখা যায়নি। আমার কাছে যা মনে হয় যে, ভোটার উপস্থিতি শতকরা ২৫ ভাগের বেশি হবে না।”
ভোট শেষে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ হিসেবে দলটির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, “বারবার ভোটের তারিখ পরিবর্তন এবং লম্বা ছুটি থাকার কারণে অনেক মানুষ গ্রামে চলে গেছে। ঢাকায় যানবাহন বন্ধ ছিল বলেও অনেকে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেননি।”
বিএনপির দক্ষিণের প্রার্থী ইশরাক হোসেন ও উত্তরের তাবিথ আউয়াল দাবি করেন, যে কয়জন ভোটার কেন্দ্রে এসেছিল তাদেরও ভোট দিতে দেওয়া হয়নি।”
সরেজমিনে দুই সিটির প্রতিটি কেন্দ্রের সামনেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের এজেন্ট ও নেতা-কর্মীদের মহড়া দেখা গেছে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ভোটার ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন। এই কর্পোরেশনে ওয়ার্ড সংখ্যা ৫৪। আর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মোট ওয়ার্ড ৭৫। মোট ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন।
বিএনপির প্রত্যাখ্যান-হরতাল
নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে রবিবার সকাল-সন্ধ্যা ঢাকায় হরতাল ডেকেছে বিএনপি। নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন।
মির্জা ফখরুল বেনারকে বলেন, “এই ফলাফল আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কেন্দ্র দখল করে, জাল ভোট দিয়ে, ইভিএম জালিয়াতি করে বিএনপি প্রার্থীদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
দলটির উত্তরের প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের অভিযোগ, অনেক কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টদের প্রবেশই করতে দেওয়া হয়নি। আর দক্ষিণের প্রার্থী ইশরাক হোসেন বলেন, “শতকরা ৬০ ভাগ কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে।”
এ ব্যাপারে সিইসি বলেন, “কেউ একজন বলবে, আর এজেন্ট বের হয়ে যাবে—এটা তো ঠিক না। এজেন্ট হিসাবে টিকে থাকার ক্ষমতা থাকতে হবে।”
তবে আওয়ামী লীগ নেতা আমুর দাবি, “বিএনপির কোনো এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়নি।”
সরেজমিনে ঢাকা উত্তরের এক নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে ভোটগ্রহণ শুরুর প্রাক্কালে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান সেগুনের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উত্তরার নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে বেনারকে তিনি বলেন, এজেন্টদের নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে গেলে ‘বিএনপির কোনো এজেন্ট থাকবে না’ বলে তাঁকে মারধর করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী আফসার উদ্দিন খানের সমর্থকরা।
“তারা আমাদের কাগজপত্র সব ছিনিয়ে নিয়ে গেছে, আমার স্ত্রীকেও মেরেছে,” উল্লেখ করে সেগুন বলেন “পুলিশ আমার এজেন্টদের কেন্দ্রের বাইরে বের করে আফসারের লোকজনের হাতে তুলে দিয়েছে।”
তবে কেন্দ্রে উপস্থিত উত্তরা পূর্ব থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “এমন কিছু ঘটেনি। তারাই (সেগুনের লোকজন) গায়ে পড়ে ঝামেলা করতে চেয়েছে।”
ঠিক আটটায় এই কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেই সেগুনকে জড়িয়ে ধরে দুঃখপ্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিক।
“আপনাকে আমি মারধর করে ‘সরি’ (দুঃখিত) বললেই কি সব শেষ? এই হচ্ছে বাংলাদেশের ভোটের নমুনা,” বলেন সেগুন।
খবর পেয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি দল নিয়ে ঘটনাস্থলে আসা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কহিনূর আখতার বেনারকে জানান, অভিযোগ খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
উত্তরের সহকারী রির্টার্নিং কর্মকর্তা এএইচএম কামরুল হাসান বেনারকে বলেন, “আমি কোনো কেন্দ্র থেকে কারও এজেন্টকে বের করে দেওয়ার প্রমাণ পাইনি।”
তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুল কাসেম জানান, কমপক্ষে ১৪টি কেন্দ্রের ব্যাপারে তিনি অভিযোগ পেয়েছেন।
এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটির ভোটগ্রহণের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রার্থীদের নেতা-কর্মীদের হামলায় ছয় গণমাধ্যম কর্মী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের। সরেজমিনে ঢাকা দক্ষিণের এক নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে হামলা ও কেন্দ্র দখলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পাওয়া গেছে এমন দুটি পক্ষের কাছ থেকে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঘুড়ি মার্কা নিয়ে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে দাঁড়ানো সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন সাকু অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের সমর্থনে ঠেলাগাড়ি মার্কা প্রতীক নিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী মাহবুবুল আলম মাহবুব ওয়ার্ডের ২১টি কেন্দ্রের ১৩টি ভবনে হামলা করেছেন।
“ভোটের প্রথম প্রহরেই তারা পাঁচ-সাতটি কেন্দ্রে চার-পাঁচশ লোক নিয়ে হামলা চালায়। এরপরই দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ভোটের পরিবেশ নেই। তাছাড়া সে (মাহবুব) এখনো হামলা চালাচ্ছে। খিলগাঁও মডেল কলেজে শত শত লোক নিয়ে অবস্থান করছে,” দুপুরে খিলগাঁও গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে দাঁড়িয়ে বেনারকে বলেন তিনি।
অন্যদিকে খিলগাঁও মডেল কলেজ কেন্দ্রে মাহবুব বেনারকে বলেন, সাকুর লোকজন তাঁর তিনটি কেন্দ্রে আক্রমণ করেছে। তাঁর কর্মীদের মেরে আহত করেছে, যারা মুগদা হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
“তারা দফায় দফায় গণ্ডগোল করার কারণেই ভোটাররা ভয়ে আসছেন না,” পাল্টা অভিযোগ তাঁর।
ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেন, “ভোটার কম হওয়ার কারণ হলো, প্রতিটি কেন্দ্রের সামনে নেতাকর্মীদের জটলা। এ ধরনের জটলা সাধারণ ভোটারদের আতঙ্কিত করে। ফলে তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে।”
তিনি বলেন, “আরেকটি কারণ হলো, পরপর কয়েকটি নির্বাচন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। সেকারণে ভোটের ব্যাপারে জনগণের কোনো আস্থা নেই। তাদের মতামত হলো, আমি ভোট দিলেই কী, আর না দিলেই কী?”
এম সাখাওয়াত বলেন, “ভোটের আগে দুপক্ষই ইভিএম এবং ভোট কেন্দ্র দখল নিয়ে অতিরিক্ত নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে। আর সেকারণে সাধারণ মানুষ ভোট কেন্দ্রে যেতে ভয় পেয়েছে।”
তিনি বলেন, “ভোট আমাদের দেশে উৎসব। ভোটের দিনে মানুষ নতুন জামাকাপড় পরে ভোট কেন্দ্রে যায়। দেখা যাচ্ছে সেই পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর এটি দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভালো খবর নয়।”
ইভিএম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে ইভিএম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ফিঙ্গার প্রিন্ট ঠিকমতো কাজ করছে না। উত্তর ও দক্ষিণের কমপক্ষে ১০ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার বেনারকে একই সমস্যার কথা বলেছে।
উত্তরার ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি স্কুল এন্ড কলেজে কেন্দ্রে এসে খোদ সিইসিও নিজের ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যবহার করে ভোট দিতে পারেননি। পরে তিনি বলেন, “তিন-চারটি উপায় আছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট না মিললেও পুরোনো আইডি কার্ড আর ভোটার তালিকায় নাম থাকলেই যে কেউ ভোট দিতে পারবেন।”
সিইসির কেন্দ্রেই ভোট দিতে গিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট না মেলায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সাধারণ ভোটার হাসনা হেনা বেনারকে বলেন, “এই ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েই আমরা কার্ড করেছি, তবুও কেন সমস্যা হচ্ছে জানি না। এমনিতে ইভিএম খারাপ না, ভালোই।”
বিএনপির ইশরাক বলেন, “ইভিএম-এর ব্যাপারে ভোটাররা অভ্যস্ত নয়। আর এই সুযোগে আওয়ামী লীগ এজেন্টরা গোপন কক্ষে ঢুকে বোতাম টিপে ভোট দিয়েছে।”
শুরু থেকেই ইভিএমএর বিরোধিতা করা তাবিথ বলেন, “সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য আমরা আগে থেকেই জানতাম।”
তবে ইভিএম-এর প্রশংসা করেছেন উত্তরার অপর একটি কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা কৃষি অধিদপ্তরের সাবেক দুই মহাপরিচালক হাবীবুর রহমান এবং এম সাঈদ আলী। হাবীবুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমি ইভিএম পদ্ধতিতে এবারই প্রথম ভোট দিলাম। মাত্র এক মিনিটের মধ্যে আমার সমস্ত কার্যক্রম শেষ করেছি। কোনো ঝামেলা নেই।”
সাঈদ আলী বেনারকে বলেন, “এটা খুবই ভালো এবং এই পদ্ধতিতে ভোট দেওয়া খুব সহজ। আমি স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে পেরেছি।”