ঢাকা সিটি নির্বাচন: অবাধ ও নিরপেক্ষ না হওয়ার অভিযোগ
2020.02.03
ঢাকা

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি বলে অভিযোগ করেছে বিরোধী দল এবং সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। অন্যদিকে সরকারি দলের নেতাদের দাবি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটার মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে হারিয়ে ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। আতিক পান ৪ লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট। আর তাবিথ পান ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৬১ ভোট।
আওয়ামী লীগের অপর প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস বিএনপির ইসরাক হোসেনকে হারিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তাপস পান ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট। ইশরাক পান ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কেনোভাবেই অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা ভোট কেন্দ্রে নানা অনিয়মের মাধ্যমে তাদের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করেছে।”
তিনি বলেন, সুজন ঢাকা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কি-না এ বিষয়ে জনসাধারণের মতামত যাচাইয়ের জন্য নির্বাচনের পর অনলাইন জরিপ পরিচালনা করেছে। প্রায় চার হাজার মানুষ এই জরিপে অংশ নেন। তাঁদের ৯৫ শতাংশ সরাসরি বলেছেন, এই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।”
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে ৪৩ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছিল। এবার ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশের কম।
ভোটারসংখ্যার এই কম উপস্থিতির তিনটি কারণ উল্লেখ করে বদিউল আলম বলেন, “নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা, ইভিএম ব্যবহার এবং নিরাপত্তার শঙ্কায় মানুষ ভোট দিতে যায়নি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর সোমবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ১৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আতিক এবং ১৭ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে তাপস ঢাকার দুই সিটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচন বিশ্লেষকেরা ভোটের এই হার স্মরণকালের সর্বনিম্ন বলছেন। প্রশ্নবানে বিদ্ধ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা।
যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা শনিবার ভোটশেষে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এ ধরনের নির্বাচন চাইনি। তবে আমাদের দায়িত্ব নির্বাচন আয়োজন করা। সেই দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছি। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর।”
এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব:) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেছেন, “নির্বাচনে ভোটারদের অনীহার বড় কারণ হলো নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। মানুষ মনে করে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। তাই, তাদের ধারণা ভোট দিয়ে কোনও ফলাফলের হেরফের হবে না।”
রাজনীতিতে বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করে রবিবার হরতাল পালন করেছে, যদিও জনজীবনে এর প্রভাব তেমন একটা পড়েনি।
বিএনপির অভিযোগ হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্র দখল করে বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন।
নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে: সরকারি দল
নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ নাকচ করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খান বেনারকে বলেন, “ইভিএমে অনিয়ম করার সুযোগ নেই। আমরা যদি নির্বাচনে অনিয়ম করতাম তাহলে ৩০ শতাংশ নয়, ভোট পড়ত কমপক্ষে ৬০ শতাংশ। এ থেকেই বোঝা যায় নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এগুলো সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের অপপ্রচার।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেছেন, “এটি নির্বাচন নামের প্রহসন। এতসব অনিয়ম হলেও পুলিশ এবং নির্বাচনী কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীনদের বাধা দেয়নি। সাংবাদিকরা নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তাঁদের ওপর হামলা হয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেছেন, “বাংলাদেশে নির্বাচন একটি উৎসব। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখছি। ভোটারদের উপস্থিতি ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো লক্ষণ নয়।”
নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ নয়টি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। এতে তারা বলেছিলেন, “আমরা আশা করি বাংলাদেশের সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং সকল রাজনৈতিক দল নাগরিকদের ভোটাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। ভোটাররা উৎসব মুখর পরিবেশে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে এবং সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ভোট গণনা হবে।”
নির্বাচন সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন হয়েছে কিনা জানতে চেয়ে বেনারনিউজের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের দূতাবাসে মেইল করা হলেও এর জবাব পাওয়া যায়নি। নয়টি দেশ ওই বিবৃতি দেওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলা হয়, বিদেশিরা রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছেন, যা অনভিপ্রেত।
সাংবাদিকদের উপর হামলা
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং আর্টিকেল নাইনটিনের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনের দিন অন্তত দশজন সাংবাদিক হামলা ও হেনস্থার শিকার হয়েছেন। সোমবার হামলার শিকার হয়েছেন আরও দুই সাংবাদিক, যারা দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মারামারি কভার করতে বাড্ডা এলাকায় গিয়েছিলেন।
এদিকে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের সময় আক্রান্ত তিন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানায় জিডি করেছেন ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ছাত্রলীগের সহসভাপতি শহিদুল ইসলাম খান রিয়াদ।
ছাত্রলীগের ওই নেতাই সাংবাদিকদের উপর আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন আক্রান্ত সাংবাদিকরা।
রিয়াদকে সোমবার সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সোমবার বলা হয়েছে, “গত ১ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় জড়িত থাকায় ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শহিদুল ইসলাম খান রিয়াদকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো।”
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন বেনারকে বলেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে ডিইউজে। তাঁর মতে, এ রকম ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধক।
এদিকে সরকার সমর্থকদের হামলায় গুরুতর আহত সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
তিনি বেনারকে বলেছেন, “আওয়ামী লীগ-সমর্থিত নব-নির্বাচিত কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ হোসেন খোকন রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসে তাঁকে মামলা না করার জন্য পরোক্ষভাবে হুমকি দিয়ে গেছেন।”
শনিবার দুপুরে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সুমনকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “হামলার ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে সোমবার পর্যন্ত ওই ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।