কারাগারে খালেদা জিয়ার দুই বছর: ‘আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি প্রায় অসম্ভব’
2020.02.07
ঢাকা

গত দুই বছর জেলে থাকলেও দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য জোরদার আন্দোলন করতে পারেনি বিএনপি, বরং সরকারের অনুমতি নিয়ে তাঁর মুক্তির দাবিতে দলটি সমাবেশ করছে।
জেলে থাকা দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবিতে এই ধরনের নরম কর্মসূচিকে দলটির রাজনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা মনে করেন, চাপ সৃষ্টি না করতে পারলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “খালেদা জিয়া কেন মুক্তি পাবেন? তাঁর মুক্তির জন্য গত দুবছরে সরকারের ওপর কোনও রকমের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি বিএনপি। আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাস্তার চাপ একটি বড় বিষয়।”
তিনি বলেন, “রাস্তায় আন্দোলন করতে না পারলে এ দেশে কোনো রাজনৈতিক অর্জন হয় না। তারা একটি সমাবেশ করতে পারে না। সরকার অনুমতি না দিলে চুপ হয়ে যায়।”
এদিকে যে সরকারের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগকে ‘ব্যবহার করে’ সাজা দেয়ার অভিযোগ, সেই সরকারের অনুমতি নিয়েই খালেদা জিয়ার কারাবাসের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে সমাবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি।
শনিবার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। তবে জনগণের চলাচলের অসুবিধা অথবা কোনও বিশৃঙ্খলা করা যাবে না বলে শর্ত দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “শনিবারের সভা থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে দলের নেতাকর্মী ও বিদেশীদের জন্য ‘বিশেষ বার্তা’ দেয়া হবে।”
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয় ঢাকার একটি দুর্নীতি বিরোধী আদালত। রায়ে অসন্তষ্ট দুর্নীতি দমন কমিশন উচ্চ আদালতে আপিল করলে তাঁর সাজা বৃদ্ধি করে ১০ বছর করে আদালত।
একই বছর ৩০ অক্টোবর জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে বিচারিক আদালত।
সব মিলিয়ে খালেদা জিয়া ১৭ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আরও কমপক্ষে ৩৪টি মামলা চলমান রয়েছে। অসুস্থ থাকায় জেলখানার বদলে তিনি এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বেনারকে বলেন, “ম্যাডাম কারাগারে আছেন। যে দুটি মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে তাতে ওনার জামিন না হওয়ার কোনও কারণ নেই। উনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। উনি তো পালিয়ে যাবেন না। তাহলে ওনাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না কেন? জামিন না হওয়ার কারণ রাজনৈতিক।”
তিনি বলেন, “সরকার চায় না উনি বাইরে থাকুন। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৩৪টি মামলা চলছে, যেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। এ থেকে বোঝা যায় খালেদা জিয়াকে আটকে রাখার পেছনে সরকারের হাত রয়েছে।”
জমিরউদ্দিন সরকারের মতে, “সরকারের মামলা, হামলা নির্যাতনের কারণে দাঁড়াতে পারছে না আমাদের নেতাকর্মীরা। সমাবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। আর মিডিয়া রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কিছু লিখছে না। ভদ্রলোকের মতো চুপ রয়েছে।”
‘আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি প্রায় অসম্ভব’
আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন দলটির অধিকাংশ নেতা। তাই রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে খালেদা মুক্ত করতে চান তাঁরা।
কিন্তু গত দুবছরে মানববন্ধন ও সমাবেশ ছাড়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো তেমন বড় কোনো কিছু করতে পারেননি তাঁরা। যদিও জাতীয় সংসদে বিএনপির সাংসদরা প্রায়ই তাঁর মুক্তি দাবি করে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। শক্ত প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে আন্দোলন করার ক্ষমতা বিএনপির নেই বলে মনে করেন দলেরই অনেক নেতা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের বিচার ব্যবস্থা তাদের ইশারায় চলে। সুতরাং, রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে আদালতের মাধ্যমে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করে রেখেছে সরকার।”
খালেদা জিয়ার পূত্র তারেক রহমানের নেতৃত্ব না মেনে বিএনপির স্থায়ী কমিটি থেকে পদত্যাগকারী নেতা জেনারেল মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমি খালেদা জিয়ার মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। আর আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার মতো ক্ষমতা বিএনপির নেই।”
তিনি বলেন, “যদি আওয়ামী লীগের ভুলের কারণে জনগণ কখনও রাস্তায় নামে তখন খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন।”
“আমি তারেকের নেতৃত্ব মানি না। সে কারণে পদত্যাগ করেছি। উনি একজন পলাতক নেতা। উনি বিএনপিকে একটি স্কাইপে পার্টিতে পরিণত করেছেন। লন্ডন থেকে স্কাইপের মাধ্যমে উনি দল চালাচ্ছেন। এভাবে রাজনীতি হয় না।”
তবে অধ্যাপক নিজাম উদ্দিনের মতে বিএনপির প্রায় সবাই তারেকের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন।
“খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর শোনা গিয়েছিল তারেকের নেতৃত্ব না মেনে আরও কয়েকজন স্থায়ী কমিটির সদস্য পদত্যাগ করবেন। কিন্তু জেনারেল মাহবুব ছাড়া কেউই পদত্যাগ করেননি। অর্থাৎ সবাই তারেকের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন,” বেনারকে বলেন অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিএনপি টিকে থাকবে বাই ডিফল্ট। কারণ আওয়ামী লীগের একটি বিরোধী শক্তি দরকার। সেটি জামায়াত বা অন্য কোনও দল হওয়ার সুযোগ নেই।”
তাঁর মতে “বিএনপি নেতারা হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে বর্তমানে আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছে তাতে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। হয়তো খালেদা জিয়া নিজেও এ কথা জানেন। সে কারণে তিনি তারেককে দলের প্রধান নেতা বানিয়েছেন।”
এদিকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বেনারকে বলেন, “খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত। দলের প্রধান তারেক লন্ডনে পলাতক। লন্ডন থেকে অনলাইনে রাজনীতি চলে না। রাজনীতি করতে হলে জনগণের সাথে থাকতে হয়।”
“খালেদা জিয়া দুর্নীতি করেছেন। আদালত তাঁকে সাজা দিয়েছেন। এখানে সরকারের কিছু করার নেই। তারা যদি খালেদা জিয়ার মুক্তি চান তাহলে নিজের দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুকম্পা চাইলে সরকার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে,” বলেন ফারুক খান।