দলের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য জামায়াত ছাড়লেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.02.15
ঢাকা
190215_Jamaat_Leader_1000.JPG ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করা সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের শীর্ষ আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ১০ জানুয়ারি ২০০৬।
[বেনারনিউজ]

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে দলকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের শীর্ষ আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।

শুক্রবার যুক্তরাজ্য থেকে ই-মেইলযোগে তিনি জামায়াতের আমির মকবুল আহমেদের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান। বেনারকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন আব্দুর রাজ্জাকের ব্যক্তিগত সহকারী কাউসার হামিদ। বেনারনিউজের কাছে তাঁর পদত্যাগপত্রের কপি রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করাকে কেন্দ্র করে জামায়াতের কোনও নেতার পদত্যাগের ঘটনা এটাই প্রথম। তা ছাড়া, তিনিই প্রথম জামায়াত নেতা যিনি ১৯৭১ সালের নেতিবাচক ভূমিকার কথা প্রকাশ্যে বললেন।

শুক্রবার জামায়াতের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বিবৃতিতে আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগপত্রের বিষয়ে দলের মহাসচিব শফিকুর রহমান বলেন, “তাঁর পদত্যাগে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। পদত্যাগ করা যে কোনো সদস্যের স্বীকৃত অধিকার। আমরা দোয়া করি তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।”

তিনি বলেন, “তিনি জামায়াতে ইসলামীর একজন সিনিয়র পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতা ছিলেন। তাঁর অতীতের সকল অবদান আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।”

১৯৮৬ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন আব্দুর রাজ্জাক। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসি বা সাজা কার্যকর হওয়া প্রায় সব নেতার আইনজীবী ছিলেন তিনি।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জামায়াত বিলুপ্ত বা নতুন নামে সংগঠনটির যাত্রা শুরু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরই মধ্যে রাজ্জাকের পদত্যাগ রাজনীতিতে কিছুটা চমক সৃষ্টি করেছে।

কী বলেছেন পদত্যাগপত্রে?

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ বিরোধী কোনো কাজের সাথে দলটি সম্পৃক্ত নয়। ১৯৬০ এর দশক থেকে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে জামায়াতে ইসলামী।

তিনি বলেন, “দলটির এ সকল অসামান্য অবদান ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে স্বীকৃতি পায়নি। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সকল সাফল্য ও অর্জন ম্লান করে দিয়েছে।”

পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন, “এসব কারণে আমি সব সময় বিশ্বাস করেছি এবং এখনও করি যে, ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে নেতিবাচক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয় বরং তৎপরবর্তী প্রজন্মকে দায়মুক্ত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য।”

তাঁর মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপলব্ধি ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল।”

পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আজও দলের নেতৃবৃন্দ ৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে পারেনি। এমনকি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রসঙ্গে দলের অবস্থানও ব্যাখ্যা করেনি। জাতির কাছে নিজেদের সেই সময়কার নেতাদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে পরিষ্কার অবস্থান নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, “যে কোনো রাজনৈতিক দল, ইতিহাসের কোনো এক পর্বে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ত্রুটি-বিচ্যুতির শিকার হতে পারে। কিন্তু তাকে ক্রমাগত অস্বীকার করে, সেই সিদ্ধান্ত ও তার ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান বজায় রাখা শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয় বরং আত্মঘাতী রাজনীতি। তা কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।”

“আমি বিগত প্রায় দুই দশক নিরবিচ্ছিন্নভাবে জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, ৭১-এ দলের ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত এবং ওই সময়ে জামায়াতের ভূমিকা ও পাকিস্তান সমর্থনের কারণ উল্লেখ করে জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত,” যোগ করেন আব্দুর রাজ্জাক।

আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, অন্য কোনও বিকল্প না পেয়ে বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্তি করে দিতে।

তাঁর মতে, “বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক দল গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সময়ের সে দাবি অনুযায়ী জামায়াত নিজেকে এখন পর্যন্ত সংস্কার করতে পারেনি।”

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “৭১ প্রসঙ্গে গ্রহণযোগ্য বক্তব্য প্রদানের ব্যর্থতা এবং ক্ষমা না চাওয়ার দায়ভার আজ তাদেরও নিতে হচ্ছে, যারা তখন এই সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত ছিল না, এমনকি যারা ৭১-এ জন্মগ্রহণও করেনি।”

তিনি বলেন, “এই ক্রমাগত ব্যর্থতা জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসাবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। ফলে জামায়াত জনগণ, গণরাজনীতি এবং দেশবিমুখ দলে পরিণত হয়েছে।”

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের রায়ে বলা হয়েছে, জামায়াত সংগঠন হিসাবে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ করেছিল। এর প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেয় হাইকোর্ট।

এই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের আপিল এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজ উদ্দীন আহমেদ বেনারকে বলেন, “ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগ একটি বড় ঘটনা। তার পদত্যাগে বোঝা গেলো জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো তাদের অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত নয়। তিনি যেহেতু পারেননি, সেকারণে পদত্যাগ করেছেন।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আব্দুর রাজ্জাক পদত্যাগ করে ও প্রকাশ্যে একাত্তরের নেতিবাচক ভূমিকার কথা বলে জামায়াতের সংস্কার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছেন। এখন দলের ভেতরে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জোরদার হতে পারে।”

তিনি বলেন, “কারণ সিনিয়র ও কট্টরপন্থী জামায়াত নেতাদের অধিকাংশই আর নেই। তাই আমার মনে হয় তারা মাফ চেয়ে নতুন দল গঠন করতে পারে।”

এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বেনারকে বলেন, “আসলে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক কথাগুলো মন থেকে বলেছেন কি না সেব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। উনি বিদেশ থেকে একটা বিবৃতি দিলেন আর আমরা বিশ্বাস করলাম? উনি দেশে এসে পরিষ্কার ভাষায় বলুন যে, জামায়াত যুদ্ধাপরাধী দল এবং তার নেতারা ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ করেছেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।