মামলা স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে শহিদুল আলমের রিট
2019.03.04
ঢাকা

গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সম্পর্কে ফেসবুকে ‘ভুল তথ্য’ প্রচারের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে তথ্য প্রযুক্তি আইনে সরকারের দায়ের করা মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।
তাঁর আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বেনারকে বলেন, সোমবার হাইকোর্টে এই রিট আবেদন দায়ের করা হয়।
আদালত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একইদিন শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার চার্জশিট আগামী ১৫ এপ্রিলের মধ্যে দাখিল করতে বলেছে বিচারিক নিম্ন আদালত।
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বেনারকে বলেন, “শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার কার্যক্রমের স্থগিতাদেশ চেয়ে আজ হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেছি। এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী রোববার হাইকোর্টে শুনানি হবে।”
তিনি বলেন, শুনানি শেষে আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে বিতর্কিত তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় করা মামলা চলবে কি না।
সারা হোসেন বলেন, শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে গুজব প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো সব ‘ভিত্তিহীন’।
তিনি বলেন, “শহিদুলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের স্বপক্ষে মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে যে লিঙ্ক দেওয়া হয়েছে সেগুলোর সাথে অভিযোগের কোনো মিল নেই। উচ্চ আদালতে তাঁর জামিনের সময় লিঙ্কগুলো যাচাই করে দেখা গেছে সেগুলো অভিযোগের সাথে মেলে না।”
সারা হোসেন বলেন, “অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে জামিনের বিরোধিতা করে উচ্চ আদালতে শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও ভুয়া’ তথ্য প্রচারের অভিযোগ এনেছেন। আদালত সে সম্পর্কে জামিন আদেশে বলেছে তিনি এমন কথা বলেননি।”
সারা হোসেন আরও বলেন, উচ্চ আদালত বলেছে মামলাটিতে অনেক প্রক্রিয়াগত ভুল আছে। এই মামলা সংবিধানের দুটি ধারার সাথে সাংঘর্ষিক।
তিনি বলেন, “সুতরাং, আমরা মনে করি শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে এই মামলা চলতে পারে না। এবং সেকারণে আমরা মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদনটি করেছি।”
শহিদুল আলমের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ বেনারকে বলেন, সোমবার ঢাকার বিচারিক আদালতে শহিদুল আলম হাজিরা দেন। আদালত ১৫ এপ্রিল পরবর্তী হাজিরার দিন ধার্য করেন।
আদালতের সাধারণ রেকর্ড অফিসার নিজাম উদ্দিন বেনারকে বলেন, সোমবার আদালত পুলিশের কাছে শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের চূড়ান্ত প্রতিবেদন চাইলে পুলিশ তা দিতে পারেনি।
তিনি বলেন, আদালত আগামী ১৫ এপ্রিল শহিদুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করতে সময় দিয়েছে।
এ সম্পর্কে ঢাকা বারের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “আদালত পুলিশকে শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার চার্জশিট দিতে বলেছে। কিন্তু পুলিশ চাইলে আবার সময় নিতে পারে। পুলিশ চাইলে আদালত সাধারণত সময় বৃদ্ধি করে।”
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর সারা দেশের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে।
শহিদুল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। তিনি ওই আন্দোলনের সময় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে এসে আন্দোলন সম্পর্কে সংবাদ প্রচার করেন।
একই সাথে তিনি কাতার ভিত্তিক আল-জাজিরা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে বক্তব্য দেন।
তিনি ওই সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ বলে মন্তব্য করেন।
ওই সাক্ষাৎকারের পর ডিবি পুলিশ গত ৫ আগস্ট রাতে নিজের ধানমন্ডির বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
পরের দিন অনলাইনে ‘ভুয়া ও মিথ্যা’ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগ এনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ।
৬ আগস্ট আদালতে তোলা হলে জামিন আবেদন বাতিল করে তাঁকে সাত দিনের পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
শহিদুল আলমের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামি শহিদুল আলম তাঁর ফেসবুক টাইম লাইনে ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কল্পনাপ্রসূত অপপ্রচার চালাচ্ছেন।
বলা হয়, শহিদুল এর মাধ্যমে জনসাধারণের বিভিন্ন শ্রেণিকে ‘শ্রুতিনির্ভর মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে উসকানি দিয়েছেন, যা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর’। সরকারকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও অকার্যকর’ রূপে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপন করেছেন তিনি।
রিমান্ড আবেদনে আরও বলা হয়, আসামি শহিদুল আলম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ জনমনে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন।
রিমান্ড শেষে ১২ আগস্ট আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত।
নিম্ন আদালতে জামিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় হাইকোর্টে জামিনের জন্য আবেদন করেন তাঁর আইনজীবীরা।
কয়েক দফা শুনানির পর গত বছর ১৫ নভেম্বর শহিদুল আলমকে জামিন দেন বিচারপতি শেখ আব্দুল আউয়াল ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
২০ নভেম্বর রাতে শহিদুল আলম কারাগার থেকে মুক্তি পান।
আল জাজিরায় শহিদুল আলম প্রসঙ্গ
সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল জাজিরায় হেড টু হেড শীর্ষক শো-তে উঠে আসে শহিদুল আলম প্রসঙ্গ। গত ১ মার্চে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তজার্তিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মেহেদী হাসানের প্রশ্নের উত্তরে গওহর রিজভী বলেন, “আল-জাজিরায় বক্তব্য দেয়ার কারণে শহিদুলকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ভুল তথ্য ছড়ানোর দায়ে, যা সহিংসতা উস্কে দিচ্ছিল। শহিদ আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।”
এ পর্যায়ে উপস্থাপক জানতে চান, পুলিশ যে শহিদুলকে মারধোর করেছে, এটা গওহর রিজভী অস্বীকার করেন কিনা?
এর উত্তরে গওহর রিভজী বলেন, আমি এটা অস্বীকার করি না। করতে পারি না কারণ আসলে কী ঘটেছে আমি জানি না।
অনুষ্ঠানে গওহর রিজভী জানান, তিনি বিশ্বাস করেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া সভ্যতা অচল। আমৃত্যু তিনি এই কথাই বলে যাবেন। তবে সরকারেরও দায়িত্ব আছে নাগরিকদের রক্ষা করা।
অক্সফোর্ড ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত এই সাক্ষাৎকার পর্বে গওহর রিজভী ছাড়াও তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল অংশ নেন। তারা হলেন- যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশি হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম, এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-এশিয়া বিশ্লেষক আব্বাস ফায়েজ ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সুইডিশ সাংবাদিক তাসনিম খলিল।