শহিদুল আলমের জামিন আবেদন কার্যতালিকা থেকে বাদ
2018.11.01
ঢাকা

অভিযোগের স্বপক্ষে পুলিশ আদালতে প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলেও জামিন মিলল না খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের।
তিন সপ্তাহের শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি মজিবুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জানিয়েছেন তাঁরা এই জামিন আবেদন আর শুনবেন না। শহিদুলের জামিন আবেদন কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন তাঁরা।
শহিদুলের আইনিজীবী সারা হোসেন বেনারকে বলেন, “আদালত নিজেই বললেন যে এফআরআই এ দেওয়া লিংকের সাথে শহিদুলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনো মিল নেই। আদালত বলেছে, পুলিশ যে প্রমাণ দিয়েছে সেটা ভুল। কিন্তু তাঁরাই আবার জামিন দিলেন না। মামলা আর শুনবেন না বলে সিদ্ধান্ত দিলেন।”
তিনি বলেন, “এটা দুঃখজনক। এখন আমরা আলোচনা করে নতুন আরেকটি বেঞ্চে জামিন শুনানি করার জন্য আবেদন করব। কোনো না কোনো বেঞ্চে আমরা জামিন পাব।”
তবে জামিন শুনানির পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বেনারকে বলেন, “শহিদুল আল-জাজিরা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে বর্তমান সরকারকে অনির্বাচিত বলেছেন। বলেছেন, এই সরকারের শাসন করার কোনো অধিকার নেই। দেশের সর্বত্র দুর্নীতি। ব্যাংক লুট চলছে। গুম-খুন নিত্যদিনের ব্যাপার, ইত্যাদি। আদালতে আজ আমরা এর পক্ষে প্রমাণ পেশ করেছি।”
তিনি বলেন, “আজ আদালত দুপক্ষের কথা শুনে বলেছেন এটি ‘আউট অব লিস্ট’। এর অর্থ হলো এই বেঞ্চ আর শহিদুল আলমের জামিন শুনানি করবেন না।”
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. বশির উল্লাহ্ বেনারকে বলেন, এই বেঞ্চ আর শহিদুল আলমের জামিন শুনানি করবেন না। তাই এখন তার আইনজীবীদের আরেকটি বেঞ্চে এই জামিন শুনানির জন্য আবেদন করতে হবে।
শহিদুলের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ বেনারকে বলেন, “শহিদুল আল-জাজিরার সাথে সাক্ষাতকারে বলেছে ‘গোটা জাতিকে তো আর বশে আনা যায় না’। কথাটা সত্য। নিশ্চয়ই তাই হবে। শহিদুল বেরিয়ে আসবে।”
আইজীবী ড. শাহদীন মালিক বেনারকে বলেন, “এই বেঞ্চ প্রায় তিন সপ্তাহ শুনানি করলেন। আবার বললেন যে পুলিশ সঠিক সাক্ষ্য হাজির করতে পারেনি। এখন তাঁরা বলছেন আর শুনবেন না। এটা সত্যিই হতাশার।”
তিনি বলেন, “হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ব্রিবত বোধ করলেন। সুতরাং বলা কঠিন কোথায় বিচার পাওয়া যাবে।”
শুনানিতে যা হলো
বৃহস্পতিবার বেলা দুটার পর আদালত শুরু হলে প্রথমেই শহিদুল আলমের জামিন শুনানি শুরু হয়।
শহিদুলের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আরমান আলী কম্পিউটারসহ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
তবে তিনি কম্পিউটারে ইন্টারেনট সংযোগ দিতে ব্যর্থ হলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আল-জাজিরায় দেয়া সাক্ষাতকার দেখতে আদালতে অনুরোধ করেন। আদালতে সেই সাক্ষাতকারটি দেখানো হয়।
সেখানে শহিদুল বর্তমান সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ বলে আখ্যায়িত করে বলেন, তাদের শাসন করার কোনো অধিকার নেই। তিনি আরো বলেন, সরকার ও তাদের লোকেরা ব্যাংক লুট করছে, গুম-খুন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের সর্বত্র দুর্নীতি।
তবে শহিদুলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে পুলিশ ফেসবুকের দুটি লিঙ্ক উল্লেখ করে বলেছে, শহিদুলের আল-জাজিরায় দেয়া বক্তব্য সেই লিঙ্কদুটিতে পাওয়া যাবে।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর আদালতের কম্পিউটার ও নেটওয়ার্ক দিয়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়।
এরপর বিচারকরা লিঙ্ক দুটিতে কী আছে তা জানতে চান। সেখানে ক্লিক করলে দেখা যায় শহিদুল আলম ফেসবুক লাইভে এসে জিগাতলা থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ওপর ধারাভাষ্য দিচ্ছেন।
আরেকটি লিঙ্কে দেখা যায় শহিদুল আলম নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে কতজন ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়েছে। আর ছাত্রলীগের ‘গুন্ডাদের’ দেখাচ্ছেন। তিনি বলছেন কোন হাসপাতালে কতজন আহত হয়েছে।
এরপর বিচারক মজিবুর রহমান তদন্তকারী কর্মকর্তা আরমান আলীকে প্রশ্ন করেন, কেন এজাহারে দেয়া লিঙ্কের সাথে বক্তব্যের মিল নেই?
জবাবে আরমান আলী বলেন, মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে শহিদুলের বক্তব্যগুলোকে সারাংশ আকারে দেয়া হয়েছে।
‘এটা উল্লেখ নেই কেন?’ প্রশ্ন করে মজিবুর রহমান বলেন, আপনি কি এজাহারের বাইরে যেতে পারবেন? মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এই এজাহার করেছেন?
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে বলেন, শহিদুল তো বলেছেন। পুলিশ এফআরআইয়ে সেগুলো সামারি আকারে উল্লেখ করেছে।
দুপক্ষের যুক্তি শেষে মজিবুর রহমান বলেন, “আউট অব লিস্ট”।
শহিদুলের আইজীবী সারা হোসেন দাঁড়িয়ে বলেন, “আপনি নিজেই বললেন লিঙ্কের সাথে অভিযোগের কোনো মিল নেই। আবার আপনারা জামিন দিলেন না। এরপরও কেন জামিন হবে না।”
বক্তব্য দিতে গিয়ে সারা হোসেন উচ্চস্বরে কথা বলা শুরু করেন। তাঁর বক্তব্যের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকেন। এর কিছুক্ষণ পর বিচারকরা আদালত ত্যাগ করেন।
দীর্ঘ আইনি লড়াই
২৯ জুলাই ঢাকায় দুই স্কুল শিক্ষার্থী বাসের চাপায় নিহত হওয়ার পর দেশব্যাপী শুরু হওয়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন শহিদুল আলম। আন্দোলন চলার সময় তিনি ফেসবুক লাইভে এসে পোস্ট দেন।
পুলিশের অভিযোগ, শহিদুল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচার করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছিলেন। সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য প্রচার করেছেন।
গত ৫ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশ তাঁর ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে শহিদুল আলমকে। পরদিন তাঁকে নিম্ন আদালতে হাজির করে পুলিশ।
পুলিশ শহিদুল আলমকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করলে আদালত জামিন আবেদন নাকচ করে পুলিশি রিমান্ড মন্জুর করে। রিমান্ড শেষে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এপর্যন্ত তাঁর জামিন প্রশ্নে নিম্ন আদালতে তিনবার ও হাইকোর্টে দুবার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
তবে জামিন পাননি দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম।
৬ আগস্টের পর গত ১৪ আগস্ট মহানগর দায়রা জজ আদালতে করা তাঁর জামিন আবেদনও নাকচ হয়ে যায়।
নিম্ন আদালতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জামিনের জন্য ২৮ আগস্ট হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন তাঁর আইনজীবীরা।
কিন্তু ৪ সেপ্টেম্বর জামিন আবেদনের শুনানিতে বিব্রত বোধ করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য হাইকোর্টের অন্য আরেকটি বেঞ্চকে নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি।
ওই বেঞ্চ জামিনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় মহানগর দায়রা জজ আদালতকে। ১১ সেপ্টেম্বর জামিন আবেদন নাকচ করে দেয় দায়রা জজ আদালত।
এক সপ্তাহ পর পুণরায় শহিদুলের জামিনের জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন তাঁর আইনজীবীরা।
৮ অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় জামিন শুনানিতে ‘শহিদুলকে কেন জামিন দেয়া হবে না’ এ বিষয়ে সরকারের ওপর রুল জারি করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। ওই রুলের জবাব দিতে সরকারকে সাত দিন সময় দেয় আদালত।
সাত দিন পার হয়ে যাওয়ার পর শহিদুলের আইনজীবীদের আবেদনের পর গত ২১ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করে আদালত।
সেইদিন শুনানি হয়নি। আদালত ২৫ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করে। তবে সেদিন শহিদুলের জামিন কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
এরপর আদালত রোববার জামিন শুনানি করার কথা জানায় কিন্তু একজন বিচারকের অসুস্থতার কারণে রোববারও জামিন শুনানি হয়নি।
পরদিন সোমবার জামিন শুনানি হয়। সেদিন আদালত বলেন তাঁরা বৃহস্পতিবার জামিনের বিষয়টি শেষ করবেন।