আমি আমার কথা বলেই যাব: শহিদুল আলমের সাক্ষাৎকার

কামরান রেজা চৌধুরী ও মেঘ মনির
2018.12.10
ঢাকা
181210-BD-shahidul-alam-620.JPG ঢাকায় বেনারনিউজের সাথে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। ৯ ডিসেম্বর ২০১৮।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

ভয় দেখিয়ে বাক স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করে দেওয়াই ছিল তাঁকে গ্রেপ্তার করার মূল কারণ; ‘সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার’ করার দায়ে একশো দিনের বেশি জেলে কাটিয়ে বেনারের সাথে সাক্ষাৎকারে বললেন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।

গত আগস্টে গ্রেপ্তারের পর দেশে ও বিদেশে তাঁর মুক্তির জন্য ব্যাপক দাবি ও প্রচেষ্টার পরও মোট ১০৭ দিন জেল খাটতে হয় শহিদুল আলমকে। বেশ কয়েকবার নিম্ন ও উচ্চ আদালতে চেষ্টার পর অবশেষে গত ২০ নভেম্বর জামিনে ছাড়া পান তিনি।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশে চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আল জাজিরা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার ও ফেসবুকে কয়েকটি পোস্ট দেবার পর ৫ আগস্ট রাতে তাঁকে তাঁর ঢাকার বাসা থেকে পাঁচ-ছয় জন লোক জোর করে তুলে নিয়ে যায়।

পরদিন আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করে পুলিশ।

“আমার ধারণা, যারা কথা বলার দুঃসাহস দেখায় তাঁদেরকে একটা বার্তা দেওয়া যে, এসব ক্ষেত্রে তারা কী করতে পারে,” নিজের গ্রেপ্তারের কারণ সম্পর্কে বলেন শহিদুল।

তাঁর গ্রেপ্তারের পরবর্তীতে দেশে ও বিদেশে ওঠা প্রতিবাদের ঝড় সম্পর্কে সরকার প্রস্তুত ছিল না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, “তাদের হিসাব সম্পূর্ণ ভুল ছিল, শুধু আমি যা করেছি তা নয়, বরং অন্যরা যা করেছে সেসব বিষয়েও, বিশেষত জেলের বাইরের মানুষজন যা করেছে, যে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে, ভয় ও আশঙ্কা উপেক্ষা করে মানুষ যেরকমভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে।”

শহিদুল আলম জানান, আল জাজিরায় সাক্ষাৎকারে তিনি যা বলেছেন, তা এখনো সমর্থন করেন।

তিনি বলেন, “আল জাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারে আমি যা বলেছি, তা আমি এখনো সমর্থন করি, এবং সেগুলো এমন কতগুলো বিষয় যা সরকারসহ প্রায় সকলে ভালোভাবেই জানে।”

“তাদেরকে মূলত যে বিষয়টা ক্ষেপিয়ে তুলেছে, খুব সম্ভবত, তাদের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, যেটা তাদের মাথা ব্যথার একটা বড়ো কারণ,” বলেন শহিদুল।

প্রসঙ্গত, আল জাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারে শহিদুল আলম বর্তমান সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।

যখন তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি বাসায় একা ছিলন বলে জানান। তিনি বলেন, এক তরুণী তাঁর দরজার বেল বাজালে তিনি দরজা খুলে দেন। তরুণীটি তাঁকে শহিদুল আংকেল বলে ডাক দিয়েছিল বলেও জানান তিনি।

তবে দরজা খোলার সাথে সাথে পাঁচ-ছয় জন লোক তাঁকে জাপটে ধরে তুলে নিয়ে যায়।

“আমি বাসায় একা ছিলাম, তবে আমি অন্যদেরকে জানানোর চেষ্টা করছিলাম। আমি চিৎকার করা শুরু করি যাতে অন্যরা আমার গলা শুনতে পায়,” বলেন তিনি।

“আমি যত দূর পারি, চেষ্টা করছিলাম ঘটনাটাকে দীর্ঘায়িত করতে,” যোগ করেন তিনি।

বাসা থেকে জোর করে লিফটে উঠিয়ে নিচে এনে তাঁকে একটি ভ্যান গাড়িতে তোলা হয়। শহিদুল আলম গাড়ির দরজার বাইরে পা বাড়িয়ে দিয়ে চেষ্টা করেন দরজা আটকাতে। একইসাথে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু ওই লোকজন তাঁর পাসহ জোর করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়।

তিনি বলেন, “আমি যাতে চিৎকার করতে না পারি, সেজন্য তারা আমার মুখ চেপে রেখেছিল। আমি ধাক্কা দিয়ে হাত সরিয়ে দেওয়ায় তারা আমার হাত দুটো পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। তারপর চোখ বেঁধে আমাকে নিয়ে চলে যায়।”

কারাগারের দিন

বাংলাদেশের কারাগারকে দুর্বিসহ হিসেবে বর্ণনা করেন শহিদুল আলম।

“ওখানে কোনো বালিশ নেই, চাদর নেই, অনেকগুলো মানুষের জন্য একটি মাত্র টয়লেট। লোকজনকে আমি বালিশ হিসেবে নিজের জুতা ব্যবহার করতে দেখেছি।”

তবে অন্য কয়েদি এবং জেলখানার কর্মীরা তাঁর প্রতি অনেক সদয় ছিলেন বলে জানিয়েছেন শহিদুল আলম। তাঁরা সব সময়ই তাঁর দেখাশোনা করতেন বলে জানান তিনি।

শুরুর দিকে একজন খুনের আসামির সাথে এক সেলে ছিলেন বলে জানান শহিদুল। ওই সেলে শুধু তাঁরা দুইজনই ছিলেন, যেখানে আমদানি সেলে, অর্থাৎ যেখানে নতুন কয়েদিদের রাখা হয় সেখানে ১৭০ জনের মতো আসামি ছিলেন বলে জানান তিনি।

“জেলখানার লোকজন আমার প্রতি খুবই সদয় ছিলেন, বিশেষত কয়েদিরা। তাঁরা প্রায়ই আমাকে কলা, ফলের জুস, দুধ এগুলো খাবার জন্য এনে দিতেন,” বলেন শহিদুল আলম।

তিনি বলেন, “আমি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ আমার সম্পর্কে জানত সবাই। আমি জেলখানার সব স্তরের কাছ থেকেই সহায়তা পেয়েছি, বিশেষত অন্য কয়েদিদের কাছ থেকে। তারা সব সময়ই আমকে দেখে রাখত, সব সময় খেয়াল রাখত যাতে আমার ক্ষেত্রে অনাকাঙ্খিত কিছু না ঘটে। আমার ধারণা, জেলার এবং কর্মীরাও আমার সম্পর্কে খুব ভালো করে জানতেন।”

জেলখানার এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে জেল ব্যবস্থার পুনর্গঠন নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন শহিদুল আলম।

তিনি বলেন, “এখন আমি জানি, জেল জিসিনটা কেমন, আমি জানি জেলে কত নিরপরাধ মানুষ রয়েছে, যাদের সেখানে থাকার কথা নয়। আমি জানি অন্য অনেককে কত নিপীড়ন সহ্য করতে হচ্ছে। সুতরাং আমি কারাগার পুনর্গঠনের জন্য একটি কাজ শুরু করতে চাই।”

ভবিষ্যতেও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কথা বলার চর্চা অব্যাহত রাখবেন জানিয়ে শহিদুল বেনারকে বলেন, “আমি আগেও সত্য বলেছি, এখনো বলছি, তখনো আমাকে গ্রেপ্তার করার কোনো অধিকার তাদের ছিল না, এখনো নেই। একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে আমি আমার কথা বলেই যাব।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।